জলবায়ু পরিবর্তনের পরিণামে গরম আর এখন ক্যালেন্ডার মানে না। ইন্ডিয়ান মেটেরিয়োলজিক্যাল ডিপার্টমেন্ট (আইএমডি) আগেই জানিয়েছে, এ বছর গরমের অনুভব হবে দ্রুত ও দীর্ঘায়িত, সংখ্যা ও তীব্রতার হিসাবে তাপপ্রবাহ ভোগাবে বেশি, উত্তর, উত্তর-পশ্চিম ভারতে দিল্লি হরিয়ানা পঞ্জাব রাজস্থান গুজরাত উত্তরপ্রদেশ মধ্যপ্রদেশের পশ্চিমাংশ-সহ দেশের এক বিরাট অংশে গ্রীষ্ম হবে সহ্যাতীত, পূর্ব ও মধ্য ভারতেও এপ্রিল থেকে জুনে গড় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা থাকবে স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি। কিন্তু জনজীবন, জীবিকা তো থেমে থাকার নয়। ভারতে শ্রমশক্তির সিংহভাগ কাজ করে অসংগঠিত ক্ষেত্রে— খোলা আকাশের নীচে বা গরমে ঘুরে। নির্মাণ শ্রমিক, রাস্তার ফেরিওয়ালা, বিক্রয়কর্মী থেকে শুরু করে খাবার বা অন্য পরিষেবা পৌঁছে দেওয়া গিগ-কর্মীদের এই অসহ্য গরমে অতিরিক্ত সুযোগসুবিধা দূরস্থান, অধিকাংশ সময় ছুটিও মেলে না। জলবায়ু পরিবর্তন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই অবস্থা পাল্টানো দরকার দ্রুত: স্বাস্থ্য, অর্থনীতি, মানবাধিকারের খাতিরে।
স্বাস্থ্যের বিষয়টি তবু সহজে অনুমেয়। প্রবল গরমে জলশূন্যতা বা হিট স্ট্রোকের জেরে পথে মৃত্যু প্রায় নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে; তবে পথচারীর মৃত্যু যত খবরে আসে, শ্রমজীবীর মৃত্যু তত নয়: তার পরিসংখ্যানটিও অজানা। বিশেষজ্ঞরা বলছেন এই খোঁজটি অবিলম্বে নেওয়া দরকার, কারণ গরমের প্রকোপ পড়ছে শ্রম ও স্বাস্থ্য এই দুইয়েই। অসহ্য গরমে কাজ করে শ্রমজীবীরা কিডনির অসুখ-সহ দুরারোগ্য ও দীর্ঘস্থায়ী নানা অসুস্থতায় ভুগছেন, এর ফলে কোপ পড়ছে রোজগারে, এমনকি কাজ থেকে ছাড়িয়ে দেওয়াও চলছে অহরহ। শ্রমজীবীদের মধ্যেও আবার নারী শ্রমজীবীদের দুরবস্থা মাত্রাছাড়া। ভারতে কর্মরতা মেয়েদের ৮২ শতাংশই কাজ করেন অসংগঠিত ক্ষেত্রে: এঁদের ‘কর্মস্থল’-এ মাথার উপর ছায়াটুকুও নেই, শৌচালয়ের ব্যবস্থা বা অস্তিত্ব কহতব্য নয়, উপরন্তু আছে কোলের শিশুদের যত্নের ‘ভার’। স্বাস্থ্য, শ্রম ও রোজগারের ন্যায্য অধিকার লঙ্ঘন, প্রতি পদে চরম অসাম্য— এমন পরিবেশেও তাঁরা মানিয়ে নিতে বাধ্য হন।
এই পরিস্থিতিতে, এবং ক্রমশ বেড়ে চলা গরমের কথা মাথায় রেখে অবিলম্বে কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারগুলিকে তাদের দায়বদ্ধতার কথা মনে করিয়ে দেওয়া দরকার। এ শুধু প্রবল গরমে কাজের ক্ষেত্রে একটু বেশি ‘মানবিক’ হওয়ার দায়বদ্ধতা নয়, আরও বেশি কিছু— জলবায়ু পরিবর্তনকে স্বীকার করে, পরিবর্তিত পরিস্থিতির নিরিখে অসংগঠিত ক্ষেত্রে শ্রমজীবী অধিকার নিশ্চিত করার দায়বদ্ধতা। শ্রম ও মানবাধিকার-বিশেষজ্ঞরা বলছেন প্রয়োজন বুঝে ‘পেড হিট লিভ’ ঘোষণা করার কথা, এমনকি সংবিধানের অতি গুরুত্বপূর্ণ ২১ নম্বর অনুচ্ছেদের অধীনে ‘রাইট টু কুল’ তথা ‘(গরমে) শীতলতার অধিকার’-এর অন্তর্ভুক্তির কথা। ২০১৯-এ ‘ইন্ডিয়া কুলিং অ্যাকশন প্ল্যান’-এ এই শীতলতার প্রয়োজনটি জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে জরুরি বলে স্বীকৃত হয়েছিল, কিন্তু সমাজের সর্বস্তরে, বিশেষত শ্রম-সাম্যের ক্ষেত্রে আজও তা কার্যকর হয়নি। জলবায়ু-বিশেষজ্ঞরা বলছেন, তাপপ্রবাহ যেমন নিয়ম হয়ে দাঁড়াচ্ছে তাতে একে ‘জাতীয় বিপর্যয়’ বলে স্বীকার করা দরকার, তবেই তার সূত্রে সরকারি খাতে অর্থবরাদ্দ বা গরমের প্রকোপে ক্ষতিগ্রস্ত শ্রমজীবীদের ‘ক্ষতিপূরণ’-এর ধারণাটি স্বীকৃত হবে।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)