Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪
Hooch

মৃত্যুমিছিল

পশ্চিমবঙ্গ, এবং ভারতে, চোলাই মদের সমস্যার সমাধান হয় না, কারণ, অর্থব্যবস্থার মূল চালিকাশক্তি হয়ে দাঁড়িয়েছে ‘রেন্ট সিকিং’ বা ‘খাজনা আদায়’।

শেষ আপডেট: ২৯ জুলাই ২০২২ ০৬:৩৪
Share: Save:

বর্ধমানে মদে বিষক্রিয়ার কারণে আট জনের মৃত্যুর রেশ কাটার আগেই আবার বিষমদের বলি হলেন এগারো জন। এ বার হাওড়ার মালিপাঁচঘড়ায়। সংখ্যাটি আরও বাড়ার আশঙ্কা। দুর্ভাগ্যের বিষয়, গত এক দশকে এ রাজ্যে এমন ঘটনা প্রায়শই ঘটতে দেখা গিয়েছে। প্রতি বারই উঠেছে প্রশাসনিক নিষ্ক্রিয়তার অভিযোগ। সম্প্রতি হাওড়া কাণ্ডের ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম হয়নি। স্থানীয়দের অভিযোগ, বেআইনি মদের আড্ডাটি থানা থেকে মাত্র ৫০ মিটারে হওয়া সত্ত্বেও পুলিশ কখনও তা বন্ধ করতে সক্রিয় হয়নি। কেন, সেই প্রশ্নের উত্তরে পশ্চিমবঙ্গের প্রধানতম সমস্যাটির কথা আরও এক বার উঠে এসেছে— অভিযোগ, মদের আসরটির মালিক শাসক দলের এক নেতার ঘনিষ্ঠ ছিলেন।

চোলাই মদের গোটা ব্যবসাই বেআইনি। বহু মৃত্যু, বহুতর প্রতিশ্রুতির পরও এই অনাচার বন্ধ না হওয়ার কারণটি আঁচ করা চলে— এই ব্যবসা শাসক দলের কোনও না কোনও নেতার প্রশ্রয়ে চলছে। সেই প্রশ্রয় সম্ভবত নগদ রজতমূল্যে কেনা। ফলে, প্রশাসনও এই অনাচার দেখতে পায় না। সেই অন্ধত্বও সম্ভবত অর্থ-হীন নয়। মাঝেমধ্যে এই বিষমদে প্রাণহানি হলে জনসমাজে শোরগোল ওঠে, তখন বেশ কিছু দিন ঠেক ভাঙার অভিযান চলে, ধরপাকড়ও হয়। আগেও প্রশাসনের তরফে এমন তাৎক্ষণিক তৎপরতা দেখা গিয়েছে, হাওড়ার ঘটনার প্রেক্ষিতে এখন খানিক হল। ইতিমধ্যেই সেই তৎপরতা দৃশ্যত ঝিমিয়ে পড়েছে, প্রতি বারই যেমন হয়। সেই সুযোগে কিছু দিনের মধ্যে আবার শুরু হয় এই বেআইনি কারবার। এই চক্র বন্ধ হয় না কেন?

প্রশ্নটি নিতান্তই আলঙ্কারিক। পশ্চিমবঙ্গের, এবং বৃহত্তর অর্থে ভারতের, অধিকাংশ সমস্যার মতো চোলাই মদের সমস্যারও সমাধান হয় না, তার কারণ, অর্থব্যবস্থার মূল চালিকাশক্তি হয়ে দাঁড়িয়েছে ‘রেন্ট সিকিং’ বা ‘খাজনা আদায়’। এই ক্ষেত্রে ‘খাজনা আদায়’টি অন্যায়, কারণ জমি, বাড়ি বা যন্ত্রপাতির মতো ন্যায্য মালিকানায় থাকা সম্পদ নয়, এই ক্ষেত্রে খাজনা আদায় করা হয় রাজনৈতিক, প্রশাসনিক বা সামাজিক ক্ষমতা থেকে। সেই ক্ষমতার মালিকানা তাঁদের নয়, কিছু নির্দিষ্ট দায়িত্ব পালনের জন্য ক্ষমতাগুলি তাঁদের উপর ন্যস্ত। তাঁরা নিজেদের ক্ষমতার অপব্যবহার করে বেনিয়মকে চলার পরিসর তৈরি করে দেন, এবং তার বিনিময়ে সেই বেনিয়ম থেকে উপার্জিত অর্থের বখরা পান। পশ্চিমবঙ্গের বর্তমান ছবি বলছে যে, এই খাজনা আদায়ের প্রক্রিয়াটি রীতিমতো প্রাতিষ্ঠানিক হয়ে উঠেছে— প্রকৃত প্রশাসনিক ব্যবস্থার সমান্তরাল একটি কাঠামো। যাঁদের উপর নিষ্পক্ষ ভাবে প্রশাসন পরিচালনার দায় ন্যস্ত ছিল, দুর্ভাগ্যক্রমে তাঁদেরই একটি বড় অংশ এই সমান্তরাল ব্যবস্থাটির বিভিন্ন স্তরে খাজনা আদায় করে চলেছেন। ভারতীয় রাজনীতিতে ‘ক্লায়েন্টেলিজ়ম’-এর পরিচিত ব্যাধিটির সঙ্গে ‘রেন্ট সিকিং’-এর ফারাকটিও স্মরণে রাখা যেতে পারে। প্রথমটির ক্ষেত্রে নেতা বা ক্ষমতাবানের উদ্দেশ্যের সঙ্গে অনুগ্রহপ্রার্থীর উদ্দেশ্যের ফারাক থাকে— ক্ষমতাবানরা মূলত আনুগত্যের বিনিময়ে সুবিধা পাইয়ে দেন। দ্বিতীয় ক্ষেত্রে উভয় পক্ষেরই মূল উদ্দেশ্য অন্যায় পথে অর্থোপার্জন। অতএব, এই ব্যাধিটির চিকিৎসার জন্য নতুনতর ওষুধ চাই। প্রশ্ন হল, সেই ওষুধ প্রয়োগ করবে কে?

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Hooch Hooch tragedy Death
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE