কোনও একটি বিশেষ সাবানের কথা শুনলেই মনে পড়ে তার ত্বককে কোমল করে তোলার ক্ষমতার কথা; আর অন্য একটি সাবানের পরিচিতি তার জীবাণুর সঙ্গে লড়াই করার সামর্থ্যের কারণে— বিজ্ঞাপনের দুনিয়ার সুলুকসন্ধান রাখেন, এমন যে কেউ বলবেন, দু’টি সাবান সম্বন্ধে ক্রেতার মগজে এই পৃথক ধারণার কারণ সেই সাবান দু’টির ‘ব্র্যান্ড পজ়িশনিং’, বা বিজ্ঞাপনের তৈরি করে দেওয়া পরিচিতি। বিজ্ঞাপনের জগতে এই পরিচিতির মূল্য অতুলনীয়। সেই কারণেই, বিজ্ঞাপন সর্বদা এমন অনুষঙ্গ খোঁজে, যা দিয়ে সেই পণ্যের পরিচিতিটি গেঁথে দেওয়া যায় ক্রেতার মনে। বিজ্ঞাপনের বাজারে জয়ী ক্রিকেট দলের অধিনায়ক বা বলিউডের উজ্জ্বল তারকাকুলের মূল্য এখানেই— পণ্যের সঙ্গে তাঁরা জুড়ে দেন নিজেদের পরিচিতিও। দু’টি কোলাজাতীয় নরম পানীয়— যার মধ্যে বস্তুগত ফারাক নেই বললেই চলে— বলিউডের দু’ধরনের নায়ককে বিজ্ঞাপনের মডেল করেছে দীর্ঘ দিন ধরে। এবং, সেই সুবাদেই একটি পরিচিত হয়েছে পুরুষালি পানীয় হিসাবে, অন্যটি তরুণ প্রজন্মের পানীয় হিসাবে।
এই মুহূর্তে আসমুদ্রহিমাচল ভারতে কার বা কোন বিষয়টির ‘রিকল ভ্যালু’ সর্বাধিক, তা নিয়ে সংশয়ের কোনও অবকাশই নেই। সিংহভাগ মানুষের মন জুড়ে রয়েছে অপারেশন সিঁদুর-এর কথা। এবং, তার সঙ্গে যুক্ত হয়ে আছে দেশের সম্মান, সামরিক শক্তি ইত্যাদির প্রশ্ন, যাকে এক কথায় বলা যেতে পারে ভারতীয় অস্মিতা; এবং তীব্র জাতীয়তাবাদী আবেগ। ব্যবসায়ীরা তাঁদের পণ্যের বিপণনে সেই আবেগকে কাজে লাগাতে চাইলে তার ঔচিত্য নিয়ে যদি বা প্রশ্ন থাকে, বিস্ময়ের কোনও অবকাশ নেই। স্মরণীয় যে, অপারেশন সিঁদুর আরম্ভ হওয়ার পরই এক অতিবৃহৎ বাণিজ্যিক গোষ্ঠী সেই নামটির আইনি অধিকার নেওয়ার পথে অগ্রসর হয়েছিল বলে খবর— যদিও, পরে তারা সেই সিদ্ধান্ত থেকে পিছু হটে। তবে, দেশের বিভিন্ন প্রান্তে একাধিক বাণিজ্যিক সংস্থা এই নামটিকে তাদের পণ্যের সঙ্গে জুড়ে ব্যবহার করতে আরম্ভ করেছে। নিশ্চিত ভাবেই তাদের আশা, এই ব্র্যান্ড পজ়িশনিং-এর কারণে সম্ভাব্য ক্রেতার মনে তাদের পণ্যটি জুড়ে যাবে জাতীয়তাবাদী আবেগের সঙ্গে। ফলে, বিক্রিও বাড়বে।
ভারতের শৌর্যকে যদি কেউ নিজের পণ্যের বিপণনের স্বার্থে ব্যবহার করতে চান, তাতে আপত্তির একাধিক কারণ থাকতে পারে। প্রথমত, সামরিক সংঘর্ষে যে পক্ষই জয়ী হোক না কেন, ক্ষতি দু’পক্ষেরই সাধারণ মানুষের হয়। শুধু সেনাদেরই নয়, সাধারণ মানুষেরও ক্ষতি। রাষ্ট্র এই কথাটি জানে, ফলে জয়ের উল্লাসের মধ্যেও সংযম থাকে। বিজ্ঞাপন সেই মর্যাদা বজায় রাখতে পারে কি না, সে প্রশ্ন থাকেই। বরং, এতে লঘুতার সম্ভাবনা প্রকটতর হয়। দ্বিতীয়ত, কোনও কিছুকে ব্যবহার করতে গেলে তার মালিকানার প্রশ্নটিকে অস্বীকার করা চলে না। অপারেশন সিঁদুর-এর গৌরবের মালিকানা কার? দ্ব্যর্থহীন উত্তর, ভারত রাষ্ট্রের। কোনও একটি বিশেষ পণ্য বা সংস্থা কি সেই গৌরবকে নিজের বাণিজ্যিক স্বার্থে ব্যবহার করতে পারে? এমনকি, রাষ্ট্রনায়করাও কি সেই কাজ করতে পারেন? নাগরিকদের যেমন এই প্রশ্নের উত্তর সন্ধান করতে হবে, তেমনই ভাবতে হবে ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলিকেও। দায়িত্ববোধের গণ্ডি অতিক্রম করা চলে না।
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)