বিহারে ভোটার তালিকা সংশোধনের প্রক্রিয়া অনেকগুলি প্রশ্নকে রাজনৈতিক বিরোধের কেন্দ্রে নিয়ে এসেছে। তার মধ্যে অন্যতম প্রশ্ন, পরিযায়ী শ্রমিক সংক্রান্ত। নির্বাচন কমিশনের মতে, কোনও পরিযায়ী শ্রমিক যে রাজ্যে কাজ করতে গিয়েছেন, তিনি সেই রাজ্যেরই ভোটার হবেন। এই অবস্থানের যুক্তি হিসাবে কমিশন জনপ্রতিনিধিত্ব আইনের কথা উল্লেখ করেছে। অন্য দিকে, বিরোধীদের দাবি, বিহার ও তার পর পশ্চিমবঙ্গের মতো রাজ্যে, যেখানে বিপুলসংখ্যক মানুষ পরিযায়ী শ্রমিক হিসাবে ভিন রাজ্যে কাজ করতে যান, সেখানকার ভোটার তালিকা থেকে তাঁদের ছেঁটে ফেলার জন্যই এই পদক্ষেপ। একাংশের মতে, পরিযায়ী শ্রমিকদের মধ্যে সংখ্যালঘুদের অনুপাত বেশি, ফলে এই রাজ্যগুলির ভোটার তালিকা থেকে তাঁদের বাদ দিলে বিধানসভা নির্বাচনের ফলাফলে তার প্রত্যক্ষ এবং তাৎপর্যপূর্ণ প্রভাব পড়বে। বিরোধীদের দাবি, কোনও পরিযায়ী শ্রমিক এক-দু’বছরের জন্য কোথাও কাজ করতে গিয়ে সেখানে ভোটার তালিকায় নাম তোলার ঝক্কি পোহাতে চাইবেন না— ফলে, নির্বাচন কমিশনের এই নিয়ম আসলে দেশের জনসংখ্যার একটি তাৎপর্যপূর্ণ অংশের ভোটাধিকার কেড়ে নেবে। বিরোধীদের কথাগুলি তাৎপর্যপূর্ণ, বিশেষত সেই সময়ে, যখন নির্বাচন কমিশনের মতো স্বায়ত্তাধীন সাংবিধানিক সংস্থার নিরপেক্ষ অবস্থান নিয়েও জনমানসে দুর্ভাগ্যজনক সংশয় তৈরি হয়েছে। অতএব, প্রশ্নগুলিকে গুরুত্ব দেওয়াই বিধেয়।
নির্বাচন হল সেই প্রক্রিয়া, যার মাধ্যমে নাগরিক আইনসভায় তাঁর প্রতিনিধিকে বেছে নেন। কোনও দল বা কোনও প্রার্থীর দিক থেকে নয়, নির্বাচনকে প্রাথমিক ভাবে দেখা উচিত নাগরিকের নিজের প্রতিনিধি বাছাইয়ের অধিকার প্রয়োগের পরিসর হিসাবে। নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি যেমন দেশের বা রাজ্যের নীতিনির্ধারণের প্রক্রিয়ায় তাঁর নির্বাচনী ক্ষেত্রের নাগরিকদের প্রতিনিধিত্ব করবেন, তেমনই নিশ্চিত করবেন ক্ষেত্রের উন্নয়ন-সম্ভাবনা— বর্তমান, এবং ভবিষ্যতের জন্য। তা হলে প্রশ্ন, কোনও নাগরিককে তাঁর কর্মসূত্রে পরিযাণের জন্য কেন নিজের প্রতিনিধি বেছে নেওয়ার অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হবে? দেখা গিয়েছে যে সাম্প্রতিক কালে পরিযায়ী শ্রমিকদের যেমন ‘বিস্মৃত ভোটার’ করে দেওয়া হয়েছে, তেমনই তাঁরা নিজেরাও বহু ক্ষেত্রে ভোট-বিমুখ হয়ে পড়েছেন, অংশত ভোটদানের অসুবিধার কারণে, এবং অংশত পরিযাণ-পরবর্তী কালে মূল বাসস্থান বিষয়ে ঔদাসীন্যের কারণে। যে কোনও সার্থক ও সক্ষম গণতন্ত্রের উদ্দেশ্য হওয়া উচিত, এই পরিযায়ীদের ভোটকে নির্বাচন প্রক্রিয়ার মধ্যে ফিরিয়ে আনা— তাঁদের বাদ দিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করা নয়।
অর্থাৎ, গণতন্ত্র কেবল ভোটগণনার বন্দোবস্ত নয়, তার মধ্যে নাগরিককে সক্ষমতা দেওয়ারও একটি অভিমুখ থাকা উচিত— একমাত্র তা হলেই তা ‘নৈতিক গণতন্ত্র’ হতে পারে। কোভিড-১৯’এর অভিজ্ঞতার পর থেকেই এই মত প্রবল হয়ে উঠেছে যে, প্রত্যেক পরিযায়ী নাগরিককেই দূর থেকে প্রযুক্তি-সহায়তায় প্রতিনিধি নির্বাচনের সুযোগ দেওয়া আবশ্যিক। পরিযায়ী কোনও বাসস্থানবিহীন নাগরিক নন, তাঁর দৃষ্টিতে পরিযাণ নিতান্তই সাময়িক প্রক্রিয়া, তিনি নিজের রাজ্যে ফিরবেন এবং সেখানেই তাঁর এবং পরিবারের ভবিষ্যৎ, সুতরাং সে বিষয়ে তাঁর আগ্রহ থাকা স্বাভাবিক। আজকের ডিজিটাল যুগে এই ব্যবস্থা করা দুরূহ হতে পারে না। কোনও পরিযায়ী শ্রমিক ভাবতেই পারেন, অর্থব্যয় করে কিংবা ছুটি নিয়ে ভোট দিতে আসতে তিনি অসম্মত বা অক্ষম। সে রকম ক্ষেত্রে তাঁর ভোট গ্রহণের ব্যবস্থা একবিংশ শতকীয় রাষ্ট্রের একটি আবশ্যিক দায়িত্ব। বিশ্বের অন্যান্য গণতন্ত্রে তেমন ব্যবস্থা ইতিমধ্যেই চালু। ভারতেও নির্বাচন কমিশন এ বিষয়ে কতখানি অগ্রসর হতে পারল, এটাই আসল প্রশ্ন। ভোট যদি ‘গণতন্ত্রের উৎসব’ হয়, পদ্ধতিটিকেও যথাসাধ্য গণতান্ত্রিক হতে হবে।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)