E-Paper

নিরপরাধ, তবু

দুর্ঘটনা, দুর্যোগই হোক বা অপহরণ ধর্ষণ হত্যার ঘটনা, সমাজমাধ্যমে মানুষ উজাড় করে দেন তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া: ভয় ক্ষোভ হতাশা ক্রোধ।

শেষ আপডেট: ১৯ জুন ২০২৫ ০৫:২০

নেতিবাচক বা অপরাধমূলক ঘটনার প্রেক্ষিতে সমাজমন কী ভাবছে, আগে তা বোঝা যেত জনপরিসরে— বাসে-ট্রামে, পাড়ার চা-দোকানে। এখন সে স্থান অধিকার করেছে সমাজমাধ্যম। দুর্ঘটনা, দুর্যোগই হোক বা অপহরণ ধর্ষণ হত্যার ঘটনা, সমাজমাধ্যমে মানুষ উজাড় করে দেন তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া: ভয় ক্ষোভ হতাশা ক্রোধ। এই তাৎক্ষণিকতার তোড়ে অনেক সময়ই ভেসে যায় কাণ্ডজ্ঞান, বিচারবোধ, তার জায়গা নেয় ব্যক্তি, গোষ্ঠী বা প্রতিষ্ঠানকে বিনা প্রমাণে বা প্রমাণের তোয়াক্কা না করেই কাঠগড়ায় তুলে দোষী সাব্যস্ত করার প্রবণতা। পুরো প্রক্রিয়াটিই ঘটে প্রবল ঘৃণা ও হিংসা আশ্রয় করে, সম্পূর্ণ অচেনা-অজানা কারও বিরুদ্ধেও বিদ্বিষ্ট হতে বাধে না। এই ঘটনাই দেখা গেল সম্প্রতি সোনম রঘুবংশী-কাণ্ডে, মেঘালয় তথা সমগ্র উত্তর-পূর্ব ভারতের মানুষদের বিরুদ্ধে সমাজমাধ্যমের একাংশ মেতে উঠলেন বিষোদ্গারে। ঘটনাটি মেঘালয়ে ঘটেছে, শুধু এই ‘অপরাধ’-এই মেঘালয়বাসীকে বলা হল ‘উগা বুগা জংলি’, ঘৃণ্য সমাজবিরোধী; উত্তর-পূর্ব ভারতকে দাগিয়ে দেওয়া হল অবাধ অপরাধভূমি হিসাবে।

অথচ যখন এই বিদ্বেষবিষ সমাজমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ছে তখন সবেমাত্র পাওয়া গিয়েছে একটি মৃতদেহ, অপরাধের কার্য-কারণ সব অজানা, তদন্তের ভার হাতে নিচ্ছে মেঘালয় পুলিশ। ক’দিনের মধ্যেই সোনম গ্রেফতার হতে জানা গেল প্রকৃত সত্য, ভাড়াটে খুনি দিয়ে রাজা রঘুবংশীর হত্যা— ইন্দোর থেকে বহু দূরে মেঘালয়ে এ কাজে সুবিধা হবে বলেই রাজ্যটি বেছে নেওয়া, এবং মেঘালয়ের কেউ কোনও ভাবেই এই ভয়ঙ্কর অপরাধের ভাগী নয়। কিন্তু ততক্ষণে যে সমাজমাধ্যমের চোখে মেঘালয় ও উত্তর-পূর্বের মানুষেরা খুনী অপরাধী সাব্যস্ত হয়ে গেলেন, তার কী হবে? এখন মেঘালয়ের নাগরিক গোষ্ঠী ‘কনফেডারেশন অব মেঘালয় সোশ্যাল অর্গানাইজ়েশনস’-সহ সাধারণ মানুষও বলছেন, সমাজমাধ্যমে যাঁরা এমন চরম দায়িত্বজ্ঞানহীন ও অমানবিক আচরণ করলেন তাঁরা ক্ষমা চান, এটুকু অন্তত মেঘালয়ের প্রাপ্য। কিন্তু কে না জানে, সমাজমাধ্যম কাঠগড়ায় যত তুলতে জানে, ক্ষমাপ্রার্থনা তত জানে না, মানেও না। সমাজমাধ্যমে বিদ্বিষ্ট মন্তব্য করেও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পার পাওয়া যায়, কারণ এই হিংসা ছড়ানোর জেরে কঠোর শাস্তি দেবে যে আইন, তার ব্যবস্থাটি এখনও পাকা নয়।

সমস্যা হল, কিছু মানুষের এই যুক্তিবুদ্ধিহীন আচরণের প্রভাব শুধু সমাজমাধ্যমেই সীমাবদ্ধ থাকে না। সেই প্রভাব পড়ে রোজকার জীবন-জীবিকাতেও। এই ঘটনার পরে যেমন মেঘালয় ভ্রমণ নিয়ে পর্যটকদের মধ্যে বিভ্রান্তি ও ভয় দেখা দিয়েছে, বহু মানুষ বেড়ানোর বুকিং বাতিল করেছেন। বর্ষায় মেঘালয় ভারত ও বিশ্বের নানা দেশের ভ্রমণপ্রেমীদের প্রিয় গন্তব্য; গত বছর সেখানে অন্তত ১৬ লক্ষ পর্যটক গিয়েছেন, এ বছর ২০ লক্ষ যাবেন বলে পূর্বানুমান ছিল কনরাড সাংমার সরকারের। সমাজমাধ্যমের জাতিবিদ্বেষ যদি ভ্রমণে বাধা হয়ে দাঁড়ায়, তার চেয়ে দুর্ভাগ্যের আর কিছুই নয়। অপরিচয়ই ঘৃণা ও দ্বেষের জন্ম দেয়, উত্তর-পূর্ব ভারতের মানুষকে যে ‘চিনা’ বা ‘চিঙ্কি’ বলে ডাকা হয়, তাতেই সেই অপরিচয়জাত ঘৃণাটি স্পষ্ট। সমাজমাধ্যমে শুভবোধসম্পন্ন নাগরিকেরা মেঘালয়ের অপমানের বিরুদ্ধে সরব হয়েছেন, পাশে দাঁড়ানো দরকার রাষ্ট্রেরও— হিংসার বেসাতিদের বিরুদ্ধে কঠোর হয়ে।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Social Media Negative Impact

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy