সাতচল্লিশ দিন আগে সংসদের বাদল অধিবেশনের দিন ঘোষণা করলেন সংসদীয় বিষয়ক মন্ত্রী কিরেন রিজিজু। ইতিমধ্যে ষোলোটি বিরোধী দল একত্রে দাবি করেছিল, পহেলগাম সন্ত্রাসবাদী আক্রমণ ও অপারেশন সিঁদুর বিষয়ে সংসদের বিশেষ অধিবেশন ডাকা হোক— সেই দাবির স্পষ্ট উত্তর না দিয়ে বাদল অধিবেশনের দিন ঘোষণা বুঝিয়ে দিল যে, বিরোধী-দাবি মানার কোনও আগ্রহ সরকারের নেই। তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ, অপারেশন সিঁদুরের মতো বড় মাপের ঘটনা প্রধানমন্ত্রী মোদীর জমানায় ঘটেনি। জনপ্রতিনিধিদের সে ঘটনা সম্বন্ধে আলোচনার অধিকার আছে তো বটেই, বস্তুত সেই আলোচনাটা না করাই গণতন্ত্রের ধর্মবিরুদ্ধ। পহেলগামের ঘটনা এবং তার পরবর্তী অপারেশন সিঁদুর নিয়ে ধোঁয়াশা প্রচুর। এত বড় একটি সন্ত্রাসবাদী হামলার পিছনে গোয়েন্দা-ব্যর্থতা কতখানি, সে কথা যেমন অজানা, তেমনই পাকিস্তানের তরফে আক্রমণে ভারতীয় সেনাবাহিনীর ক্ষয়ক্ষতি এবং অসামরিক ক্ষতির পরিমাণও অজ্ঞাত। সেনাপ্রধান বিদেশে বসে যে ইঙ্গিত দিয়েছেন, সে বিষয়েও স্পষ্টতা দরকার। যুদ্ধবিরতির সংবাদটি ওয়াশিংটন ডিসি থেকে ‘ঘোষিত’ হল কেন, কেবল বিরোধী নেতা রাহুল গান্ধী নন, দেশবাসীও সে বিষয়ে কৌতূহলী। ভবিষ্যতে ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা এবং গোয়েন্দা তথ্যের ক্ষেত্রে অপারেশন সিঁদুরের কী প্রভাব পড়বে, সে প্রশ্নটিও অতি গুরুত্বপূর্ণ। সরকার নিজের মতো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে, এবং প্রধানমন্ত্রী তাঁর অবসর অনুযায়ী সে কথা ঘোষণা করে দেবেন— গণতন্ত্র এ ভাবে কাজ করে না। সংসদে জনপ্রতিনিধিদের প্রশ্নের সন্তোষজনক উত্তর দেওয়া, এবং জাতীয় নিরাপত্তার প্রশ্নে সকলকে সঙ্গে নিয়ে চলাই ছিল গণতান্ত্রিক কর্তব্য। প্রধানমন্ত্রী তাতে ব্যর্থ, আরও এক বার।
সংসদ নামক পরিসরটির গুরুত্ব বিষয়ে দেশের বর্তমান শাসকদের সম্যক ধারণা রয়েছে, এমন ভাবার অবকাশ গত এগারো বছরে ভারত খুব বেশি পায়নি। কিন্তু তার পরও, বর্তমান সময়টি সংসদীয় গণতন্ত্রকে পূর্ণ মর্যাদায় পুনঃপ্রতিষ্ঠা করার একটি সুযোগ প্রধানমন্ত্রীকে দিয়েছিল। অপারেশন সিঁদুরকে কেন্দ্র করে ভারতের বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলি এক বিরল অবস্থান নিয়েছিল— যাবতীয় দ্বন্দ্ব এবং বিরোধকে সরিয়ে রেখে তারা কেন্দ্রীয় সরকারের, প্রধানমন্ত্রীর পাশে দাঁড়িয়েছিল। সেই ইতিবাচক পদক্ষেপের উত্তরে বিরোধী পক্ষকে অপারেশন সিঁদুর সংক্রান্ত আলোচনা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়ার শরিক করা শুধুমাত্র সৌজন্যের প্রকাশ হত না, তা হত গণতন্ত্র হিসাবে পরিণতমনস্কতারও পরিচায়ক। প্রধানমন্ত্রী সে সুযোগ হেলায় হারালেন। কারও মনে হতেই পারে, বিরোধীপক্ষের সদিচ্ছাকে তিনি ব্যবহার করলেন নিজের ক্ষুদ্র রাজনৈতিক স্বার্থ চরিতার্থ করতে। গণতন্ত্রের ভবিষ্যতের পক্ষে তা সুসংবাদ নয়।
বিশেষ অধিবেশন ডাকতে সরকারের তীব্র অনীহাকে বিরোধীপক্ষ নাম দিয়েছে ‘সংসদাতঙ্ক’। এই প্রথম নয়, বরং গত এগারো বছরে বার বার স্পষ্ট হয়েছে যে, কেন্দ্রীয় সরকার সংসদকে এড়িয়েই দেশ পরিচালনা করতে চায়। অতি গুরুত্বপূর্ণ বহু আইন তৈরি হয়েছে অধ্যাদেশের মাধ্যমে— আইনসভায় বিন্দুমাত্র আলোচনা ব্যতিরেকেই। প্রশ্ন হল, কিসের ভয়? তৃতীয় দফায় সংসদে বিজেপির একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা না থাকলেও বিবিধ ভাবে শরিক দলদের সন্তুষ্ট রাখতে তারা সক্ষম, সুতরাং সংসদে শাসকপক্ষ নিরাপদ। অর্থাৎ, তারা যা চায়, সংসদ শেষ পর্যন্ত সে দিকেই রায় দেবে। তা হলে, ভয় কি শুধু আলোচনাতেই? বিরোধীদের প্রশ্নের সম্মুখীন হওয়ায়? কী এমন কথা আছে, যা প্রকাশ না করতে চাওয়ার তাড়নায় গোটা সংসদীয় প্রক্রিয়াটিকেই কার্যত অবান্তর করে তোলা যায়? অথচ ২০১৪ সালে প্রথম বার সংসদে প্রবেশ করার সময় প্রধানমন্ত্রীর সাষ্টাঙ্গ প্রণামের দৃশ্যটি অনেকেরই মনে আঁকা হয়ে আছে। আজ সেই দৃশ্য এক বিরাট আকারের পরিহাসের মতো ভারতীয় গণতন্ত্রকে প্রত্যহ তাড়িত করছে।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)