E-Paper

গণতন্ত্রের পালা

দ্বিতীয় উদ্বেগটি বৃহত্তর, তৃণমূল দল কিংবা পশ্চিমবঙ্গের সীমানার মধ্যে আবদ্ধ নয়। ভারতে সাংবিধানিক গণতন্ত্রের ধারক-বাহক হল তার রাজনৈতিক দলগুলি।

শেষ আপডেট: ১২ মে ২০২৩ ০৮:০৮
অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের জনসংযোগ যাত্রা।

অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের জনসংযোগ যাত্রা।

দলীয় কর্মীদের মতামতের ভিত্তিতে পঞ্চায়েত নির্বাচনের প্রার্থী বাছাই করতে ‘জনসংযোগ যাত্রা’ শুরু করেছিল তৃণমূল। তাই নিয়ে জেলার পর জেলায় চলছে প্রবল বিশৃঙ্খলা— ব্যালট পেপার ছেঁড়া, ব্যালট বাক্স ভাঙা, ছাপ্পা ভোট, ভোটার তালিকায় কারচুপি, সদস্যদের মারামারি, ভাঙচুর, কিছুই বাকি নেই। আশঙ্কা হয়, ‘ভোট করানো’র পরিচিত পদ্ধতিগুলি তৃণমূল দলের অভ্যন্তরের নির্বাচনেও অভ্যাসমতো প্রযুক্ত হচ্ছে। হিংসাহীন, সুশৃঙ্খল ভোট যে সম্ভব, কিংবা ভোটের ফল শান্ত ভাবে মেনে নেওয়া চলে, তা হয়তো শাসক দলের কর্মী-সমর্থকরা আর কল্পনা করতে পারেন না। অনেক তৃণমূল সদস্য দলের ভোটাভুটির পরে বিরোধী দলে যোগ দিয়েছেন। আপাতত বিরোধী দলের নেতারা নানা কটাক্ষে বিদ্ধ করছেন শাসকদের, আর তৃণমূল নেতারা সংঘাতের তীব্রতাকে লঘু করে দেখাতে চাইছেন। কিন্তু বিষয়টিকে লঘু করা চলে না। ২০১৮ সালে পশ্চিমবঙ্গের পঞ্চায়েত নির্বাচনের ব্যাপক হিংসা আজও জাগরূক রাজ্যবাসীর মনে। সে বার শাসক দলের হিংসায় এবং পুলিশের কর্তব্য-বিমুখতায় কয়েক হাজার বিরোধী নেতা মনোনয়নও জমা দিতে পারেননি। সেই পরিপ্রেক্ষিতে সাম্প্রতিক ঘটনাগুলি নিয়ে বেশ উদ্বেগ দেখা দিচ্ছে। প্রথমত, দলের সাংসদ, বিধায়ক-সহ শীর্ষ স্থানীয় নেতাদের উপস্থিতি সত্ত্বেও গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব সামলানো যাচ্ছে না, প্রায় সব জেলায় নামাতে হয়েছে পুলিশকে। দলের ঘোষণা অনুসারে এই কার্যসূচি চলবে দু’মাস। পুলিশকে ক্রমাগত দলীয় কার্যক্রম সামলানোর দায় নিতে নির্দেশ দেওয়া বস্তুত শাসক দলের প্রশাসনিক ক্ষমতার অপব্যবহার। বার বার অভিযোগ উঠেছে, তৃণমূলের অভ্যন্তরের দ্বন্দ্ব সামাল দেওয়া, এবং নানা ধরনের প্রশাসনিক ও দলীয় কার্যসূচির রূপায়ণের জন্য শাসক দল পুলিশকে কাজে লাগাচ্ছে। এ বার দলের অভ্যন্তরের ভোট করাতে পুলিশের উপর নির্ভরতা সেই অভিযোগকেই আরও দৃঢ় করবে। যে দল নিজের সদস্যদের নিয়ে সুষ্ঠু নির্বাচন করাতে পারে না, সে দল কী করে রাজ্যে সুশৃঙ্খল ভাবে নির্বাচন করাবে, সে প্রশ্ন উঠতে বাধ্য।

দ্বিতীয় উদ্বেগটি বৃহত্তর, তৃণমূল দল কিংবা পশ্চিমবঙ্গের সীমানার মধ্যে আবদ্ধ নয়। ভারতে সাংবিধানিক গণতন্ত্রের ধারক-বাহক হল তার রাজনৈতিক দলগুলি। কিন্তু প্রায় কোনও বৃহৎ রাজনৈতিক দলই তার গঠনতন্ত্রে বা কার্যপ্রণালীতে গণতান্ত্রিক নয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই কোনও এক প্রবল নেতা তাঁর কতিপয় ঘনিষ্ঠ অনুগামীদের নিয়ে দলের ক্ষমতাকেন্দ্রটি দখল করে রয়েছেন। তাঁদের মদতকারী ব্যক্তিরা দলীয় নেতৃত্বের স্থানগুলি উপহার পান। এই জন্যই ভারতের সংসদ ও বিধানসভাগুলিতে কোটিপতিদের আধিক্য ক্রমশ বেড়েছে, আর্থিক দুর্নীতি বা ফৌজদারি অপরাধে অভিযুক্ত ব্যক্তিরাও উপর্যুপরি মনোনয়ন পাচ্ছেন। জনসংগঠনে দক্ষ, জনস্বার্থ সুরক্ষায় আগ্রহী নেতাদের বস্তুত এই ক্ষমতাতন্ত্রের সঙ্গে লড়াই করতে হয়, এবং অধিকাংশই পরাহত হন।

তৃতীয়ত, জনপ্রতিনিধিদের কার্যকলাপ সম্পর্কে মতামত প্রকাশের পরিসর দিতে নারাজ রাজনৈতিক দলগুলি। পশ্চিমবঙ্গের ত্রিস্তরীয় পঞ্চায়েত ব্যবস্থা দেশে-বিদেশে স্থানীয় স্বশাসনের একটি সফল দৃষ্টান্ত বলে বিবেচিত হয়। কিন্তু গ্রাম সংসদ সভা বা গ্রামসভা ডেকে মানুষের মতামত শোনার কাজটি কতটুকু হয়েছে তৃণমূল আমলে? যে দলের শীর্ষ নেতারা যে কোনও সমালোচনাকে, এমনকি সাংবাদিকের প্রশ্নকেও ‘বিরোধীর আক্রমণ’ বলে মনে করেন, সে দলের সদস্যরা জনমতের অবাধ প্রকাশকে যে কোনও উপায়ে প্রতিহত করতে চাইবে, এটাই তো স্বাভাবিক। তৃণমূলের সর্বভারতীয় সভাপতি অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় বয়সে নবীন। এই বিড়ম্বনা থেকে তিনি অন্তত এই শিক্ষাটি গ্রহণ করতে পারেন— গণতন্ত্রের আবাহন সারা বছর করা চাই। হঠাৎ ডাক পাঠালে সে আসে না।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

West Bengal Panchayat Election 2023 Abhishek Banerjee TMC

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy