E-Paper

সীমাহীন বিপদ

মুখ্যমন্ত্রী হিমন্তবিশ্ব শর্মার যুক্তি হল, ২০১১ সালে অসমের মুসলমান জনসংখ্যা ছিল ৩৪ শতাংশ, এবং তার ৩১ শতাংশই ‘বহিরাগত’। এই ধারা অব্যাহত ধরে নিয়ে পনেরো বছর পরের আগাম পূর্বাভাস দিয়েছেন তিনি। কিন্তু কিছু গুরুতর প্রশ্ন উঠে আসে এখান থেকেই।

শেষ আপডেট: ২৯ জুলাই ২০২৫ ০৭:২৯

জনসংখ্যা হ্রাস পাচ্ছে, এখনই সাবধান হতে হবে— রক্ষণশীল উগ্রবাদী জাতীয়তার চিরকালীন যুক্তি। কেবল ভারতে নয়, বিশ্বদুনিয়ার সর্বত্র উগ্র দক্ষিণপন্থী রাজনীতির ধুয়া এটি। মুশকিল হল, অতি-ব্যবহারে সত্যও অনেক সময়ে তার ধার কিংবা গুরুত্ব হারিয়ে ফেলে। ফলে অসমের জনসংখ্যার ধারা কোন অভিমুখে কতখানি বদলাচ্ছে, মুখ্যমন্ত্রী হিমন্তবিশ্ব শর্মার হম্বিতম্বি শুনে সে বিষয়ে কোনও ধারণা মেলা অসম্ভব। তিনি সম্প্রতি নিশ্চিত প্রত্যয়ের সঙ্গে বললেন যে অসমের হিন্দু-মুসলমান জনসংখ্যার অনুপাত ২০৪১ সালের মধ্যে পঞ্চাশ-পঞ্চাশ হয়ে যাবে। সমগ্র দেশ জুড়ে তাঁর এই দাবি ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হল, প্রচারমাধ্যমে হইচই পড়ল। অথচ এই দাবির মধ্যে কতটা সত্য, কতটা তথ্য, তা নিয়ে বিস্তর প্রশ্ন ও সংশয় থেকে গেল। মুখ্যমন্ত্রী হিমন্তবিশ্ব শর্মার যুক্তি হল, ২০১১ সালে অসমের মুসলমান জনসংখ্যা ছিল ৩৪ শতাংশ, এবং তার ৩১ শতাংশই ‘বহিরাগত’। এই ধারা অব্যাহত ধরে নিয়ে পনেরো বছর পরের আগাম পূর্বাভাস দিয়েছেন তিনি। কিন্তু কিছু গুরুতর প্রশ্ন উঠে আসে এখান থেকেই। প্রথমত, ৩১ শতাংশ বহিরাগত মুসলমান সে কথা এত নিশ্চিত ভাবে জানা গেল কী করে, যখন ২০১১ সালে জনশুমারি হলেও কোনও নাগরিকতার সমীক্ষা হয়নি। দ্বিতীয়ত, যদি ধরেও নেওয়া হয় যে দেশভাগের পর নিয়মিত ভাবে পূর্ব পাকিস্তান ও বাংলাদেশ থেকে অসমে মানুষজন ঢুকে এসেছেন, তাঁদের কত অংশ মুসলমান তা জানার নিশ্চিত কোনও উপায় আছে কি? তৃতীয়ত, ১৯৪৭-পূর্ব সময়েও তো অসম মুসলমান-বহুল রাজ্য ছিল। মুসলমান-গরিষ্ঠ অঞ্চল হিসাবেই তা ধার্য হত। সে ক্ষেত্রে স্বাধীন ভারতে অসম রাজ্যের মুসলমান জনতার কত অংশ দেশভাগের আগেই ছিলেন, আর কত অংশ পরে ভারতে এসেছেন, তারও কি কোনও স্পষ্ট হিসাব আছে? সে রাজ্যে কারা বহিরাগত, আর কারা তা নন— এ প্রশ্নের সন্তোষজনক উত্তর যখন এতই অস্পষ্ট, মুখ্যমন্ত্রীর কাছেও তা স্পষ্ট হওয়ার কথা নয়।

দক্ষিণ এশিয়ার জনসমাজে একটি বিরাট ধাঁধা দেশভাগ-পরবর্তী এই ক্রমান্বিত সীমান্ত পারাপার। উদ্বাস্তুই হোক, অনুপ্রবেশকারীই হোক, তার মধ্যে এক বিরাট অংশ হিন্দু— যে হিন্দুরা পূর্ব পাকিস্তানে ও পরবর্তী বাংলাদেশে সংখ্যালঘু হয়ে যাওয়ার ফলে নিরাপত্তার আশায় কিংবা অন্যান্য সামাজিক-অর্থনৈতিক কারণে ও দেশ থেকে চলে আসার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। অবশ্যই মুসলমান জনতাও আছেন, যাঁরা অর্থনৈতিক ও অন্যান্য কারণে বৃহৎ প্রতিবেশী দেশের আকর্ষণ বোধ করেছেন। এই বিরাট বাস্তবের সামনে ধ্বস্ত পূর্ব ভারতীয় সীমান্তরেখা কোনও কালেই দৃঢ় অবস্থান নিতে পারেনি। রাষ্ট্রিক সীমান্ত-নমনীয়তার কারণে যাঁরা অনায়াসে প্রবেশ করেছিলেন, আজ রাষ্ট্রের নেতাই তাঁদের শাস্তি দিতে উদ্যত। তা ছাড়া, ২০১১ সালের ‘বহিরাগত’ বিষয়ে তেমন স্পষ্টতা না থাকলে আজ কোন প্রক্রিয়ায় ২০৩১ বা ২০৪১ সালের জনসংখ্যার সম্ভাব্য অনুপাত অনুমান করা যাচ্ছে?

অবশ্যই হিমন্তবিশ্ব শর্মার মতো নেতারা এ সব জটিলতায় যেতে চান না। তাঁরা সমাজ-অর্থনৈতিক বিষয়ে ভাবিত নন, শুধু রাজনীতি নিয়েই সদাতাড়িত। সেই রাজনীতি সঙ্কীর্ণ স্বার্থান্বেষী সংখ্যাগুরুবাদের। সেই রাজনীতির কোনও গণতন্ত্র মানার দায় নেই। তাই মুখ্যমন্ত্রী নিজেই অসমের অরণ্যাঞ্চল এবং সমতলের জমি রক্ষার দাবিতে স্থানীয় মানুষকে নিজেদের হাতে অস্ত্র তুলে নেওয়ার মতো ভয়ঙ্কর কথা বলতে পারেন। বিরোধী আক্রমণের সামনে নিজের বক্তব্য সমর্থনে বলতে পারেন, বিভাজনের রাজনীতি নয়, তাঁর লক্ষ্য রাজ্যের সমাজ-সংস্কৃতি রক্ষা করা। এই ‘লক্ষ্য’ সাধনের জন্য তিনি যে গোটা রাজ্যকে হানাহানির দিকে এগিয়ে দিতে পারছেন, তার কারণ— কেন্দ্রীয় সরকারের শীর্ষ নেতৃত্ব দিল্লি থেকে তাঁকে সেই সীমাহীন স্পর্ধা ও সাহস জুগিয়ে চলেছে।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Himanta Biswa Sarma Assam

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy