পশ্চিমবঙ্গে দুর্গাপূজা বহু দিনই নিতান্ত ধর্মীয় গণ্ডি অতিক্রম করে পরিণত হয়েছে এক বিপুল সামাজিক উৎসবে। তার শিল্পের দিকটি হেলাফেলার নয়— কলকাতার দুর্গাপূজা এখন বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ ‘পাবলিক আর্ট’-এর পরিসর হিসাবে পরিচিত। এ বছরের পুুজোয় যোগ হল একটি নতুনতর মাত্রা— বহু মণ্ডপেই শিল্প হয়ে উঠল রাজনৈতিক বার্তা প্রদানের মাধ্যম। এমনটা এই প্রথম ঘটল, তা বলা চলে না। স্বাধীনতার আগেও ঘটেছে এমন ঘটনা— কোথাও অসুর তৈরি হয়েছে ইংরেজের আদলে, কোথাও আবার দেবসেনাপতি কার্তিকের মুখটি গড়া হয়েছে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর মতো। তার পরবর্তী কালেও তৈরি হয়েছে এমন ‘শিল্প’, যেখানে অসুরের মুখটি মহাত্মা গান্ধীর। সম্প্রতি, লকডাউনে পরিযায়ী শ্রমিকদের অবর্ণনীয় যন্ত্রণা উঠে এসেছিল পূজামণ্ডপে; উত্তরপ্রদেশের লখিমপুর খেরিতে প্রতিবাদরত কৃষকদের উপরে বিজেপি সাংসদ-পুত্রের এসইউভি চালিয়ে দেওয়ার ঘটনাও প্রতীকায়িত হয়েছিল এক মণ্ডপে। কিন্তু, সেই সমস্ত রাজনীতির থেকে আরও খানিক দূরে স্বতন্ত্র হয়ে দাঁড়াল ২০২৫-এর পুজো। মণ্ডপের রাজনীতির বয়ানে এ বার নির্ভুল দলীয় চিহ্ন। রাজ্য রাজনীতির দুই যুযুধান পক্ষ— তৃণমূল কংগ্রেস ও বিজেপি— এ বার দুর্গাপূজাকে বেছে নিয়েছিল তাদের রাজনৈতিক ভাষ্যের প্রচার-পরিসর হিসাবে। রাজ্যের শাসক ও পূজা অনুদানের দাতা হিসাবে তৃণমূল তুলনায় সুবিধাজনক অবস্থানে; তবে বিভিন্ন পূজাকে দলীয় অনুদান প্রদান এবং নেতাদের মণ্ডপ পরিদর্শনের ঘোষিত কর্মসূচিতে বিজেপিও পিছিয়ে থাকেনি। রাজ্য রাজনীতির এ এক নতুন পর্যায়; রাজনীতির সঙ্গে নাগরিকের সংযোগের নতুন পরিসরও বটে।
উভয় পক্ষই পূজার পরিসরটি ব্যবহার করেছে দলের রাজনৈতিক অবস্থান অনুসারে— ‘তৃণমূলের পুজো’গুলি বাঙালি পরিযায়ী শ্রমিকের বিপন্নতা অথবা বাঙালি অস্মিতার কথা বলেছে; ‘বিজেপির পুজো’গুলি উগ্র জাতীয়তাবাদী বয়ানে স্থিত, অথবা ‘হিন্দু বাঙালি’র ‘প্রকৃত ইতিহাস’ উন্মোচনে ব্যাকুল। যেমন, ১৯৪৬-এর সাম্প্রদায়িক সংঘাতের কথা উঠে এসেছে মণ্ডপে। পুজোর মাসখানেক আগে, অগস্ট মাসের মাঝামাঝি, ১৯৪৬ নিয়ে একটি ‘প্রপাগান্ডা’মূলক ছবিকে কেন্দ্র করে বিপুল হইচই হয়, এবং তার পরই পুজো মণ্ডপের থিম হয়ে উঠল ১৯৪৬-এর সংঘাত— সম্ভবত সমাপতন নয়, এর পিছনে একটি নির্দিষ্ট পরিকল্পনা থাকাই সম্ভব। মনস্তত্ত্ব বলে, সম্পূর্ণ অজানা কোনও ‘তথ্য’ প্রথম বার শুনলেও তা মনের অগোচরে ছাপ রেখে যায়— দ্বিতীয় বার শুনলে তাকে অনেক বেশি সত্য বলে মনে হতে থাকে। ওয়টস্যাপে পাওয়া বার্তার প্রতিফলন পুজোর প্যান্ডালে এসে চোখে পড়লে তাকে অনেক বেশি সত্য মনে হওয়া বিচিত্র নয়।
যে কোনও বাস্তবের মতোই ১৯৪৬-ও বহুস্তরীয়, জটিল। সেখানে নৃশংসতা যেমন আছে, কর্তৃপক্ষের স্বেচ্ছা-গাফিলতি যেমন আছে, তেমনই আছে ধর্মের বেড়া টপকে ভিন্ ধর্মের বিপন্ন মানুষকে রক্ষা করার মানবিক চেষ্টা। এ বিষয়ে একাধিক প্রামাণ্য গবেষণাপত্র জনপরিসরেই আছে— গত এক-দেড় মাসেও প্রকাশিত হয়েছে একাধিক লেখা। কিন্তু, যে-হেতু উগ্র জাতীয়তাবাদী বয়ান এই সামগ্রিক সত্যে আগ্রহী নয়, ফলে আশঙ্কা জাগে যে, পুজোর সংহতির পরিসরটিকে তারা বিভাজনের আয়ুধ করে তুলতে চায়। একটি নির্দিষ্ট ক্ষুদ্র স্বার্থতাড়িত দৃষ্টিকোণ থেকে ইতিহাসের পুনর্নির্মাণ করলে তার বিপদ কী রকম, গত এক দশকে ভারত তা বিলক্ষণ বুঝেছে। দুর্গাপূজার অতি ব্যতিক্রমী সর্বজনীন চরিত্রসম্পন্ন পরিসরটিকে এই কাজে ব্যবহার করা আসলে কি বাঙালির সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্যকেই আঘাত করা নয়? ইতিহাসকে ফিরে দেখা জরুরি, নতুনতর তথ্যের আলোকে তার পুনর্মূল্যায়নও জরুরি। কিন্তু, যে কাজ গবেষকের, তাকে গণপরিসরে এনে ফেলে যথেচ্ছ উপসংহার নির্মাণ করা অতি বিপজ্জনক।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)