পূজা আসার আগেই কলকাতা মেট্রোর একাধিক কঠিন রোগ ধরা পড়েছিল। অতিবর্ষণে লাইনে জল, অপর্যাপ্ত রেক নিয়ে হঠাৎ সম্প্রসারণে কাবু হয়ে পড়া, তদুপরি কবিসুভাষ মেট্রো স্টেশন ‘বসে যাওয়া’য় প্রধান লাইনটিতে প্রান্তিক স্টেশন ও সময়ে রেক ঘোরানো নিয়ে অশেষ দুর্গতিতে যাত্রীদের দুর্ভোগের সীমা ছিল না। এ-হেন রোগী উৎসবের দিনগুলির বাড়তি যাত্রী-ভার কী ভাবে সইবে— সেই আতঙ্ক খণ্ডন করে উৎসব মোটামুটি নির্বিঘ্নেই পার করেছে মেট্রো এবং বেশি যাত্রী-বহনে বাড়তি মুনাফাও অর্জন করেছে। কিন্তু পূজা শেষেই আবার যন্ত্রণা শুরু। পরিস্থিতি এখন এতটাই বিগড়েছে যে, এক কালে গতির প্রতীক, যানজট এড়িয়ে এ-প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে পৌঁছে বিস্তর সময় বাঁচিয়ে যার প্রযুক্তি ও আধুনিকতার গুণগানে নাগরিক সুবিধার বড়াই করা যেত, সেই মেট্রো এখন শহরের পিছিয়ে পড়ার স্থিরচিত্র। মেট্রো দাঁড়িয়ে গেলেই শহরও স্তব্ধ হয়ে যায় ও জগদ্বিশ্বকে জানিয়ে দেয় যে একটি মহানগর এই পরিষেবাটির উপর কতখানি নির্ভরশীল এবং সেখানে অন্যান্য গণপরিবহণ কতটা অপ্রতুল।
কেবলই শঙ্কা ও প্রশ্ন— স্টেশনে ট্রেন কি আদৌ আসবে? ওঠা যাবে? গন্তব্যে পৌঁছবে? পথে দাঁড়িয়ে থাকবে বা মাঝপথে নামিয়ে দেবে না তো? মোদ্দা কথা, স্কুলে-অফিসে প্রয়োজনে সময় পৌঁছতে মেট্রোকে আর ভরসা করা যাচ্ছে না। যখন সময়ে ট্রেন বা বিমান ধরার নিশ্চয়তাটুকুই দেওয়া যায় না তখন স্টেশনের চাকচিক্য দেখানোর বা নদীর নীচ দিয়ে চলার বিজ্ঞাপনের মূল্য কী? দীপাবলির আগের সপ্তাহে উত্তর-দক্ষিণ মেট্রো পরিষেবা যে কারণে দুপুরে দেড় ঘণ্টার উপর ব্যাহত থাকল, দুর্ভাগ্য ক্রমে সেই ফাটল দেখা দিল মহাত্মা গান্ধী রোড ও গিরিশ পার্ক স্টেশনের সংযোগস্থলে, তাও আবার টের পেলেন চালক, ট্রেন চালাতে গিয়ে। পরিষেবা থামিয়ে মেরামতি করতে হল, ফলে প্রভাব ছড়াল শহরের প্রাণকেন্দ্রে। এই অপ্রস্তুত দশা, বিশৃঙ্খলা দেখাল যে, ফাঁক আসলে আপৎকালীন ব্যবস্থায়, রক্ষণাবেক্ষণে। চার দশক পেরোনো উত্তর-দক্ষিণ মেট্রোর প্রধান পথ— তার লাইন, সিগন্যাল পদ্ধতি, সুড়ঙ্গ সবই বয়সের কারণেই নিয়মিত নজরদারি দাবি করে। সেই সন্ধ্যাতেই ইস্ট-ওয়েস্ট মেট্রোয় ৪৫ মিনিটের অচলাবস্থায় দেখা গেল, আধুনিকতম ব্যবস্থাতেও তাল মেলাতে হিমশিম।
লোকাভাবে পাঁচটি পথে কর্মীরা ঘুরেফিরে রাত জেগে রক্ষণাবেক্ষণের কাজ করছেন, অর্থাভাবে নানা কাটছাঁটে সমস্যা বাড়ছে, সমাধানের চেষ্টা চলছে ইত্যাদি চেনা বুলি আওড়াতে থাকলে অনিয়মকেই যে নিয়ম বলে চলতে দেওয়া হচ্ছে, সেই অবহেলাই স্পষ্ট হয়। শুধু স্পষ্ট নয়— সুষ্ঠু সমাধান কবে ও কোন উপায়ে মিলবে। এই ধোঁয়াশারই প্রতিতে মহানগর ক্লান্ত। বিভ্রান্তি ও ক্ষোভ দ্রুত বর্ধমান। কর্মীদের যাত্রীদের সঙ্গে যোগাযোগে পটু করে তুলতে, মেট্রোর কর্মধারায় প্রশিক্ষিত করতে ও যাত্রীর চাপ সামাল দেওয়ার মতো পরিকাঠামো নির্মাণে যে খরচ তার জন্য যে শুধু টিকিটের দাম বাড়ানোর মতো অপ্রিয় সিদ্ধান্ত নিতে হবে, তাও নয়। দেশেরই অন্য শহরের মেট্রো ‘সমাধান বিক্রয়’ কৌশলের মাধ্যমে লাভ বাড়ানোর রাস্তা দেখিয়েছে। কলকাতা মেট্রো প্রাচীনতম, অভিজ্ঞতা অঢেল, আয় বাড়ানোর এমন নানান উপায়ে তাঁদের দর তো বেশি হওয়ারই কথা ছিল।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)