কলেজ পরিচালন সমিতিগুলিতে তৃণমূল ছাত্র পরিষদের সদস্যদের প্রভাব যে কলেজ কর্তৃপক্ষকেও ছাপিয়ে যাচ্ছে, এ সংবাদে পশ্চিমবঙ্গে কে-ই বা আর আশ্চর্য হবে? এ রাজ্যের উচ্চশিক্ষা ক্ষেত্রটি দলীয় রাজনীতির প্রভাবমুক্ত ছিল না বাম আমলেও। অভিযোগ ছিল, বাহ্যিক নিয়মরক্ষার আড়ালে এন্তার স্বজনপোষণ চলছে। তৃণমূল আমলে বাহ্যিক নিয়মপালনের ভণিতাটুকুও সর্বদা বজায় থাকেনি। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের স্বাতন্ত্র্য নস্যাৎ করা, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের উপর সরকারের দখলদারি কায়েম করার মানসিকতা নিয়ে যে ‘মনোজিৎ মডেল’ তৈরি হল, তা সোজাসাপটা রাজনৈতিক দখলদারির নকশা। দক্ষিণ কলকাতা আইন কলেজের কসবা ক্যাম্পাসে এক আইন-ছাত্রীর গণধর্ষণের অভিযোগ উঠেছে কলেজের অস্থায়ী কর্মী মনোজিৎ মিশ্রের বিরুদ্ধে। অতঃপর প্রকাশিত হয়েছে যে মনোজিৎ ব্যতিক্রম নন— রাজ্যের নানা কলেজে তৃণমূল ছাত্র পরিষদের প্রভাবশালী সদস্য, তথা কলেজ প্রাক্তনীদের দাপট অবাধ, সীমাহীন। কখনও বিধিনিয়ম, রীতি-নীতির খোলসটুকু বজায় রেখে, কখনও সরাসরি তা অগ্রাহ্য করে এদের নিয়োগ করা হয়েছে স্থায়ী বা অস্থায়ী পদে। এক-এক জন একাধিক কলেজের পরিচালন সমিতির সদস্য। এদের পথ মসৃণ হয়েছে দু’ভাবে— ছাত্র ইউনিয়ন নির্বাচন স্থগিত রেখে, এবং আইনে পরিবর্তন করে। ২০১৭ সালে আইন বদলের পরে কলেজ পরিচালন সমিতিতে চার জন শিক্ষক প্রতিনিধির সংখ্যা কমে তিন জন, এবং দু’জন শিক্ষাকর্মী প্রতিনিধি কমে এক জন হয়েছেন। যোগ হয়েছে উচ্চ শিক্ষা সংসদের এক জন সদস্য। শিক্ষক ও শিক্ষাবিদরা কলেজ পরিচালন সমিতিতে মনোনীত প্রতিনিধিদের বিষয়ে বার বার সতর্ক করেছেন। সে সবই উপেক্ষিত হয়েছে। শিক্ষক নিয়োগ থেকে ছাত্র-ভর্তির পরীক্ষা, সব বিষয়েই ছাত্র-নেতাদের অঙ্গুলিহেলনে ছোট নেতাদের আধিপত্য নিরঙ্কুশ হচ্ছে। কসবার আইন কলেজে মনোজিৎ-অনুগামীদের ‘টিম এমএম’ কত ছাত্রছাত্রীকে হয়রান করেছে, কত জন কলেজ ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছে, গত কয়েক দিনে তার বিবরণ সামনে এনেছে নানা সংবাদপত্র।
জেলায় জেলায় সরকারি কলেজগুলিতে ‘মনোজিৎ মডেল’ কাজ করছে, এই আশঙ্কা ভিত্তিহীন নয়। ফলে অবধারিত ভাবেই কলেজ কর্তৃপক্ষের ক্ষমতা ক্রমশ কমছে। আইন-বহির্ভূত নানা সিদ্ধান্তে সিলমোহর পড়ছে। গত বছর আর জি কর মেডিক্যাল কলেজ কাণ্ডেও সামনে এসেছিল জবাবদিহির দায়হীন রাজনৈতিক সংস্কৃতি। শাসক দল-ঘনিষ্ঠ চিকিৎসক, প্রশাসকরা শিক্ষকদের নিয়োগ, বদলি নিয়ন্ত্রণ করেছেন, ছাত্র-ভর্তি প্রভাবিত করেছেন, নানা ধরনের দুর্নীতি অবাধে চলার সুযোগ করে দিয়েছেন। তাঁদের বশংবদ ছাত্র-নেতারা বিভিন্ন কলেজ-ক্যাম্পাসে ভীতিপ্রদর্শনের আবহাওয়া তৈরি করেছে। আর জি কর মেডিক্যাল কলেজের প্রাক্তন অধ্যক্ষ সন্দীপ ঘোষের বিধি-বহির্ভূত কার্যকলাপের বিরুদ্ধে ছাত্রছাত্রীদের অভিযোগকে স্বাস্থ্য দফতরের কর্তারা গুরুত্ব দেননি। যদি দিতেন, তা হলে হয়তো কলেজের মধ্যে পড়ুয়া-চিকিৎসকের ধর্ষণ-হত্যা ঘটতে পারত না।
আর জি কর কাণ্ডের পর যে বিপুল প্রতিবাদের ঢেউ প্রায় তিন মাস রাজ্যকে আন্দোলিত করেছিল, তা কেবল একটি ধর্ষণের বিচারই চেয়েছিল, এমন নয়। চেয়েছিল শিক্ষাঙ্গনে দুর্বৃত্ত লালন-পালনের রাজনৈতিক সংস্কৃতির অবসান। সে দিন রাজনৈতিক কৌশল আর পুলিশি চাপ তৈরি করে প্রতিবাদীদের ন্যায্য দাবিগুলি অগ্রাহ্য করেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বছর না ঘুরতেই দেখা গেল, যাদের হাতে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ন্ত্রণের রাশ তুলে দিচ্ছে তাঁর সরকার, সেই স্পর্ধিত দুর্বৃত্তেরা ক্ষমতা-মদে উন্মত্ত, নিজেদের পৈশাচিক প্রবৃত্তি নিয়ন্ত্রণে অক্ষম। উচ্চশিক্ষায় এই লাগামহীন দুর্নীতি, বেপরোয়া হিংসার রাজনীতি রাজ্যের চূড়ান্ত লজ্জা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)