E-Paper

কুমিরছানা

পরিযায়ী শ্রম বর্তমান অর্থনৈতিক উৎপাদন ব্যবস্থার এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। শ্রমের অবাধ যাতায়াত জারি থাকলে তাতে শ্রমিক ও লগ্নিকারী, উভয়েরই লাভ।

শেষ আপডেট: ০১ অগস্ট ২০২৫ ০৫:০২

পরিযায়ী শ্রমিকের নিরাপত্তার দাবি তুলে তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যে সুতীক্ষ্ণ রাজনৈতিক বোধের পরিচয় দিলেন, তা পাওয়া গেল না মুখ্যমন্ত্রী মমতার প্রশাসনিক সমাধানে। ভিন রাজ্যে বাংলার শ্রমিকদের নির্যাতন যে হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির নিষ্ঠুর কৌশল, এবং তার মোকাবিলা রাজনৈতিক ভাবেই করতে হবে, মমতার এই নির্ণয় অভ্রান্ত। কিন্তু প্রশাসক হিসাবে তাঁর পথপ্রদর্শন হয়ে দাঁড়াল কুমিরছানা প্রদর্শন— সেই কর্মশ্রী প্রকল্প। ইতিপূর্বে মমতা কর্মশ্রীকে কেন্দ্রের মহাত্মা গান্ধী জাতীয় গ্রামীণ রোজগার সুরক্ষা প্রকল্পের বিকল্প বলে দেখাতে চেয়েছিলেন। সম্প্রতি এক প্রশাসনিক বৈঠকে মমতা আধিকারিকদের নির্দেশ দিলেন, বিজেপি-শাসিত রাজ্যগুলি থেকে বাংলার শ্রমিকদের ফিরিয়ে এনে, কাজ জোগাতে হবে। তার জন্য জোর দিতে হবে কর্মশ্রী প্রকল্পে। অর্থাৎ, কর্মশ্রী হবে ভিন রাজ্যে রোজগারেরও বিকল্প। এ রাজ্যে নথিভুক্ত পরিযায়ী শ্রমিক ২২ লক্ষ, বাস্তব সংখ্যাটি ৫০ লক্ষাধিক বলে অনুমান। নানা রাজ্যে শিল্প, কৃষি ও পরিষেবা ক্ষেত্রে এত শ্রমিক যে আয় করেন, কোনও সরকারি প্রকল্প থেকে তার সমতুল্য রোজগার হবে, এ কি সম্ভব? একুশে জুলাই ‘শহিদ দিবস’-এর মঞ্চেও মমতা পরিযায়ী শ্রমিকদের রাজ্যে ফেরার ডাক দিয়েছিলেন। কিন্তু তা ছিল দলীয় মঞ্চ। রাজনৈতিক ভাষণে নেতারা নিজেদের সাফল্য নিয়ে কিছু বাড়তি দাবি করেই থাকেন। সেখানে নির্বিচার আশ্বাস-বিতরণ অতটা অবাক করে না। কিন্তু বোলপুরের প্রশাসনিক বৈঠকে মুখ্যমন্ত্রী বিষয়টি নিয়ে এসেছেন কার্যসূচির পর্যায়ে। পরিযায়ী শ্রমিকদের ঘরে ফেরানো এবং কর্মশ্রী প্রকল্পে জোর দিয়ে কাজের জোগান দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন আধিকারিকদের।

অথচ, একশো দিনের কাজের প্রকল্পের কাছাকাছি যে পৌঁছতে পারেনি রাজ্য সরকারের কর্মশ্রী প্রকল্প, তা এত দিনে স্পষ্ট। এ বছর বাজেট-বক্তৃতায় রাজ্যের মন্ত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য উল্লেখ করেছেন যে ২০২৪-২৫ সালে ২৭ কোটি কর্মদিবস তৈরি হয়েছিল, মোট ১২,৩৫৫ কোটি টাকা দেওয়া হয়েছে মজুরি হিসাবে। তুলনায়, একশো দিনের কাজের প্রকল্পের ২০২১-২২ সালে ৩৬ কোটি কর্মদিবস তৈরি করেছিল পশ্চিমবঙ্গ। তবে প্রধান আপত্তি কাজের পরিমাণ নিয়ে নয়। কেন্দ্রের সঙ্গে রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের পরিণামে রাজ্যের রাজস্ব ব্যয় করে মজুরি জোগানো রাজ্যের বোঝা বাড়াচ্ছে। গ্রামের কর্মপ্রার্থীর কাছেও কর্মশ্রীর প্রসারের নির্দেশ আশা জাগায় না। কারণ, কেন্দ্রীয় প্রকল্পে শ্রমিকের কাজের চাহিদার উপর কাজের পরিমাণ নির্ভর করে। কর্মশ্রী প্রকল্পে বিভিন্ন সরকারি দফতরের কাজের চাহিদার উপর নির্ভর করে শ্রমিকের কাজের পরিমাণ। এ মাসেই মুখ্য সচিব মনোজ পন্থ জেলাশাসকদের কাছে জানতে চেয়েছেন, গত বছর কর্মশ্রী প্রকল্পে জুলাই পর্যন্ত সাত কোটি কাজ দেওয়া গিয়েছিল, এ বছর তা তিন কোটির আশেপাশে রয়েছে কেন? এর উত্তর, গ্রামে যত কাজের প্রয়োজন, প্রতি বছর ঠিক তত কাজের প্রয়োজন সরকারি দফতরগুলির না-ই হতে পারে।

পরিযায়ী শ্রম বর্তমান অর্থনৈতিক উৎপাদন ব্যবস্থার এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। শ্রমের অবাধ যাতায়াত জারি থাকলে তাতে শ্রমিক ও লগ্নিকারী, উভয়েরই লাভ। পুঁজির অবাধ গতির মতো, শ্রমের গতিকেও গতিময় এবং ঝুঁকিহীন করে তোলা প্রশাসনের কাজ। সেই কর্তব্যের পথ আটকাচ্ছে দলীয় রাজনীতি। বিরোধীরা বার বার শ্রমিকের ভিন রাজ্যে যাত্রাকে রাজ্য সরকারের কাজ জোগানোর ব্যর্থতা বলে দেখাতে চান। আর ক্ষমতাসীন দল দেখাতে চায়, রাজ্যে যথেষ্ট কাজ আছে, পরিযায়ী শ্রমিক ঘরে ফিরুন। পরিযায়ীর পাঠানো অর্থ রাজ্যের আয়ের কতখানি, সে হিসাব আড়াল করতে চায় সরকার। এই অপরিণামদর্শী রাজনীতি থেকে শ্রমের মুক্তি প্রয়োজন। পরিযায়ীর নিরাপত্তার প্রশ্নটি জাতীয় রাজনীতির কেন্দ্রে আসার যে আশা মাথা তুলেছিল, তা তলিয়ে যেতে বসেছে যুক্তিহীন নীতি আর অকারণ আস্ফালনের রাজনীতিতে।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Mamata Banerjee Migrant Labours

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy