E-Paper

সত্যসন্ধানী

জীবনের যে সব মুহূর্ত আমাদের বিব্রত, লজ্জিত করতে পারে, যা কিছু আমরা আড়াল করতে চাই— অপরের থেকে তো বটেই, এমনকি নিজের থেকেও— সে সবই গান্ধী একেবারে উন্মুক্ত করে দিয়েছেন।

শেষ আপডেট: ১৪ ডিসেম্বর ২০২৫ ০৬:১৬
মহত্মা গান্ধী।

মহত্মা গান্ধী। ফাইল চিত্র।

জেলের হুকুম হয়েছিল ছ’বছরের, ইয়ং ইন্ডিয়া পত্রিকায় রাষ্ট্রদ্রোহিতা-দুষ্ট প্রবন্ধ লেখার জন্য। খারাপ স্বাস্থ্যের কারণে বছর দুয়েকের মাথায়, ১৯২৪ সালে, ইয়েরওয়াড়া জেল থেকে ছাড়া পেয়ে যান মোহনদাস কর্মচন্দ গান্ধী। তাতে স্বস্তির বদলে একটু যেন আক্ষেপের সুর ফুটে উঠেছে গান্ধীর লেখায়— আর একটা বছর জেলে থাকলে তাঁর আত্মজীবনীটা সম্পূর্ণ হয়ে যেত! ঘনিষ্ঠদের অনুরোধে নিজের জীবন নিয়ে আগেই লেখা শুরু করেছিলেন তিনি, মাঝে বোম্বের দাঙ্গা আর অসহযোগ আন্দোলন এসে পড়ায় ছেদ পড়ে গিয়েছিল। দক্ষিণ আফ্রিকায় সত্যাগ্রহের ঘটনা অবধি লিখে ফেলার পর ছাপা শুরু করার অনুমতি দেন। নভেম্বর, ১৯২৫ গুজরাতি নবজীবন সাপ্তাহিক পত্রিকায় প্রকাশিত হয় প্রথম কিস্তি। এ বছরটি গান্ধীর আত্মজীবনীর শতবর্ষ। গান্ধী-প্রতিষ্ঠিত প্রকাশনা সংস্থা নবজীবন ট্রাস্ট জানিয়েছে, দেশ-বিদেশে এখনও অবধি এক কোটিরও বেশি বিক্রি হয়েছে বইটি, নানা ভারতীয় ভাষায় ৬১ লক্ষ। তামিল, মালয়ালম ভাষায় অনুবাদের চাহিদা চড়া— কোনও কোনও বছরে এক লক্ষ বইও ছাপতে হয়েছে। বোঝাই যাচ্ছে, ‘অ্যান অটোবায়োগ্রাফি, অর দ্য স্টোরি অব মাই এক্সপেরিমেন্টস উইথ ট্রুথ’ প্রবেশ করেছে সেই সব বইয়ের তালিকায়, যেগুলিকে প্রতি প্রজন্ম নতুন করে আবিষ্কার করে। নতুন নতুন প্রশ্নের উত্তর খোঁজে। শতবর্ষের ওপার থেকে ছাপ্পান্ন বছরের যে প্রৌঢ় কথা বলে চলেছেন, আজকের তরুণ-তরুণীরা তাঁর কথায় কখনও মুচকি হাসেন, কখনও ভুরু কুঁচকান, কখনও বা জোর তর্ক জোড়েন। এড়িয়ে যেতে পারেন না।

অথচ, আত্মজীবনী আদৌ লেখা উচিত কি না, তা নিয়ে গান্ধীর মনে দ্বন্দ্ব ছিল। তাঁকে এক জন বলেছিল, সে সময়ে গান্ধী যে আদর্শ বা নীতিতে বিশ্বাস করেন, পরে যদি তা বদলে যায়, তা হলে পাঠকের সঙ্গে প্রতারণা হবে না কি? পাঠক তো বাতিল নীতিকেই ‘গান্ধীর নীতি’ ভেবে আঁকড়ে থাকবেন। গান্ধী তাই বইটির ভূমিকায় বলেছিলেন, এ হল সে যাবৎ তাঁর জীবনে সত্যের প্রয়োগ করার কাহিনি। ‘সত্য’ কী, সত্য-অনুসারী জীবনই বা কেমন জীবন, সে বিষয়ে তাঁর সমসাময়িক বহু বিশিষ্ট মানুষের সঙ্গে গান্ধীর দ্বিমত হয়েছে। আর আজ, মাত্র চার-পাঁচ প্রজন্মের ব্যবধানে, এ কথা প্রায় অবিশ্বাস্য মনে হয় যে অহিংসা, অচৌর্য, সত্য, ব্রহ্মচর্য, অপরিগ্রহের মতো নীতির উপর এক জন রাজনৈতিক নেতা নিজের জীবন স্থাপন করেছিলেন, অন্যদেরও করতে অনুপ্রাণিত করেছিলেন। যে গুজরাতি স্তবকগুলি তিনি তুলে দিয়েছেন জীবনীতে— “এক বাটি জল পেলে প্রতিদানে দাও পূর্ণ ভোজন, কেউ অভিবাদন জানালে করো মস্তক অবনমন, একটি পয়সা কেউ দিলে তাকে দাও সোনা, যদি বাঁচতে চাও তবে জীবন রাখতে ব্যস্ত হোয়ো না”— তা স্রেফ নীতিবাক্য না হয়ে জীবনের কম্পাস হতে পারে, এ কি বিশ্বাস্য? তবু দেখা যায়, জীবনদর্শনে গান্ধীর সঙ্গে যাঁর দূরত্ব হাজার যোজন, তাঁকেও বইটি স্পর্শ করে। এমন নয় যে ভাষার ব্যবহারে, ঘটনার বিন্যাসে, সাহিত্যের প্রসাদগুণে এই জীবনী অনন্য-সাধারণ। গান্ধীর ভাষা সাদাসিধে, পর্বগুলি এগিয়েছে সময়ের গতি ধরে, আশেপাশের চরিত্ররা অধিকাংশই কেউকেটা নন।

যেখানে এ বই অসামান্য, তা হল অকপটতা। জীবনের যে সব মুহূর্ত আমাদের বিব্রত, লজ্জিত করতে পারে, যা কিছু আমরা আড়াল করতে চাই— অপরের থেকে তো বটেই, এমনকি নিজের থেকেও— সে সবই গান্ধী একেবারে উন্মুক্ত করে দিয়েছেন। নিজের কোনও খামতি, কোনও দুর্বলতা, অপারগতা উল্লেখ করতে ছাড়েননি। ‘মহাত্মা’ তকমা যিনি পেয়েছেন, কী প্রয়োজন ছিল তাঁর পিতার মৃত্যুমুহূর্তে রমণে লিপ্ত থাকা, কিংবা যৌনকর্মী-গমনের কথা বলার? রাজনীতি কিংবা অধ্যাত্মসাধনার জগতে আর কে এমন করে নিজেকে মেলে ধরেছেন? এই বিস্ময় থেকে ক্রমে এই বোধ জন্ম নেয় যে, নিরামিষ ভোজন, যৌন-সংযম বা দেশপ্রেমের প্রচার করছেন না গান্ধী। তাঁর বইটি হল নিজের প্রতি সততার আহ্বান। নিজের নানা ভ্রান্তির মধ্যে দিয়ে গান্ধী দেখাচ্ছেন অন্তরে আর বাহিরে, বিশ্বাসে আর আচরণে সমতার মূল্য। যতক্ষণ না গান্ধী নিজের কথা, ব্যবহার, পোশাক, খাদ্য— প্রতিটি খুঁটিনাটিতে অন্তরের সমর্থন পেয়েছেন, ততক্ষণ তাঁর মধ্যে এক অস্থিরতা চলেছে। যখন তা পেয়েছেন, তখন কোনও ভয় কিংবা লোভ বিচ্যুতি ঘটাতে পারেনি। চাপিয়ে-দেওয়া প্রত্যাশাকে প্রত্যাখ্যান করার এই প্রবল শক্তি প্রতিটি পাঠককে চ্যালেঞ্জ করে চলেছে, প্রতি দিন।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Father Of Nation Gandhiji

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy