হিজাব-বিরোধী বিক্ষোভের আঁচ ছড়িয়েছে বিদেশেও। রয়টার্স
নীতি-পুলিশের হেফাজতে ২২ বছর বয়সি মাহশা আমিনির মৃত্যুর ঘটনায় স্ফুলিঙ্গ ছিটকে পড়েছে ইরানের নাগরিকদের মধ্যে জমে থাকা ক্ষোভের বারুদের স্তূপে। কার্যত দেশের প্রতিটি প্রান্তে বিক্ষোভের বিস্ফোরণ হচ্ছে। নাগরিকের ক্ষোভ বহুবিধ— ইসলামি মৌলবাদী শাসনে যেমন নাগরিক অধিকার অতি সীমিত, মহিলাদের অধিকার তার চেয়েও কম, তেমনই অর্থনীতির শ্লথগতি, কর্মসংস্থান, সামাজিক উন্নয়ন ইত্যাদির অভাব নিয়েও মানুষ অতিষ্ঠ। ইরানে গত কয়েক বছরে একাধিক বিক্ষোভ আন্দোলন হয়েছে, সেই আন্দোলন দেশের সরকার কঠোর হাতে দমনও করেছে। এই দফাতেও বজ্রমুষ্টি প্রয়োগের লক্ষণ স্পষ্ট— বিপুল ধরপাকড় চলছে; যেটুকু সংবাদ বাইরে আসছে, তাতে সংশয় যে, অত্যাচারের মাত্রা ক্রমেই বাড়ছে। প্রবল দমনপীড়নের মাধ্যমে এই আন্দোলনকে থামিয়ে দিতে পারবে ইব্রাহিম রাইসির সরকার, তেমন আশঙ্কা প্রবল। কিন্তু, পরিণতি যা-ই হোক না কেন, এই আন্দোলনটি যে চরিত্রে আগের আন্দোলনগুলির চেয়ে পৃথক, তাতে সংশয়ের অবকাশ নেই। এই আন্দোলন সমাজের কোনও একটি নির্দিষ্ট বৃত্তের গণ্ডিতে আটকে পড়েনি, তার প্রধান কারণ, আন্দোলনটির সূচনায় কোনও বিশেষ শ্রেণির আর্থিক সমস্যার প্রশ্ন ছিল না, ছিল মেয়েদের উপর রাষ্ট্রীয় খবরদারির বিরুদ্ধে পুঞ্জীভূত ক্ষোভ। সেই খবরদারি শ্রেণির গণ্ডিতে সীমাবদ্ধ নয়— ফলে ক্ষোভের আগুনও ছড়াতে পেরেছে তুলনায় সহজে।
আন্দোলনটি স্বতঃস্ফূর্ত। সেখানেই তার জোর, কিন্তু সেখানেই তার দুর্বলতাও বটে— আন্দোলনের কোনও অভিজ্ঞ, কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব নেই। এই আন্দোলনের কেন্দ্রে রয়েছে মূলত যুব সম্প্রদায়, যাঁদের অধিকাংশেরই জন্ম ১৯৭৯ সালের ইসলামি বিপ্লবের পরে। তরুণ প্রজন্মের পক্ষে আন্দোলনের বড় হাতিয়ার ইন্টারনেট। ফেসবুক সে দেশে নিষিদ্ধই ছিল— মূলত ইনস্টাগ্রাম ও হোয়াটসঅ্যাপের উপর নির্ভর করে এই আন্দোলন সংগঠিত হচ্ছিল। স্বভাবতই ইরানের সরকার ইন্টারনেট সংযোগ সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে। তার ফলে আন্দোলনকারীরা পরস্পরের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছেন। অন্য দিকে, এই আন্দোলনের পক্ষে প্রবলতম কণ্ঠস্বরগুলির অধিকাংশই ইরানের বাইরে, নির্বাসনে। তাঁদের থেকেও বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছেন আন্দোলনকারীরা। অনুমান করা চলে, এই সুযোগটিকে কাজে লাগাবে রাইসির প্রশাসন। এমনিতেও, ইরান সরকার এই বিক্ষোভকে পশ্চিমি ষড়যন্ত্র বলে চিহ্নিত করেছে, যেমনটা তারা করেই থাকে। সে দেশের সরকার এখনও এই আন্দোলনকে দেখে উদ্বিগ্ন, সে কথা ভাবার কারণ নেই— কিন্তু এ কথাও ঠিক যে, যাকে শ্রেণিসংহতি বলা যায়, ইরানে তেমন ঘটনা এর আগে সাম্প্রতিক কালে ঘটেনি।
ইরানের সরকার দমনপীড়নের পথে বেছে নিয়েছে, তাতে আশ্চর্য হওয়ার কারণ নেই। কিন্তু, এখানে একটি গভীরতর প্রশ্ন রয়েছে— ইরানে যে সংস্কারপন্থী দাবি উঠেছে, তাকে অগ্রাহ্য করা কি শুধুই অগণতান্ত্রিকতার কারণে? সম্ভবত নয়, কারণ মহিলাদের উপর কঠোর নিয়ন্ত্রণের নীতি, যার প্রকটতম প্রকাশ সে দেশের হিজাব আইন, ইরানের ইসলামি মৌলবাদী শাসনের একেবারে কেন্দ্রীয় যুক্তির অন্তর্গত। সেই নিয়ন্ত্রণ শিথিল করার অর্থ, খোমেইনির শাসনের যুক্তিকাঠামোকেই অস্বীকার করা। ইরানের শাসকদের পক্ষে তা অসম্ভব। এবং, সেই কারণেই সে দেশের বিক্ষোভটির তাৎপর্য বৈশ্বিক। হিজাব পরতে বাধ্য করা, আর হিজাব না-পরতে বাধ্য করা আসলে একই মুদ্রার দুই পিঠ। যেখানেই শাসনব্যবস্থার গোড়ায় উদার মানবাধিকারকে অস্বীকার করার প্রবণতা থাকে, সেখানে শেষ পর্যন্ত নিপীড়নই শাসনের আয়ুধ হয়ে দাঁড়ায়। অতএব, সাবধান! যে কোনও মৌলবাদই গণতন্ত্রের, ও সাধারণ মানুষের, স্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকর।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy