মাত্র উনিশ সেকেন্ডের একটা ভিডিয়ো দিয়ে শুরু। আহামরি কিছু নয়, চিড়িয়াখানায় হাতির এনক্লোজ়ারের বাইরে এক তরুণ কিছু বলছেন। ২০০৫ সালে আনকোরা এক ওয়েবসাইটে এই ছোট্ট ভিডিয়ো যখন আপলোড করা হয়েছিল, কেউ ভাবতেও পারেননি, তা ছিল আসলে মহাসিন্ধুর প্রথম বিন্দুটি। সে দিনের সেই ওয়েবসাইটই কুড়ি বছর পর আজ ‘ইউটিউব’ নামে দুনিয়া কাঁপাচ্ছে, বদলে দিয়েছে মানুষের ‘দেখা’র দর্শন। টিভির চৌকো বাক্স মানুষের চার দেওয়ালের মধ্যে গোটা বিশ্বকে এনে দিয়েছিল, কিন্তু ডিজিটাল প্রযুক্তি ও আন্তর্জালকে সঙ্গী করে, মোবাইল বা স্মার্টফোনের আধারে যে বিপ্লব ইউটিউব সম্ভব করেছে তার জুড়ি মেলা ভার। এই কুড়ি বছরে তার ভান্ডারে ২০ বিলিয়নেরও বেশি ভিডিয়ো, বিশ্ব জুড়ে ইউটিউব ব্যবহার করছেন দু’শো কোটিরও বেশি মানুষ, প্রতি মাসে গড় ‘অ্যাক্টিভ ইউজ়ার’ ছাড়িয়েছে ১০০ কোটি।
সংখ্যা-গুরুত্বের এ-হেন তথ্য ইউটিউব সম্পর্কে আরও বিস্তর বলা যায়। এই সংস্থা ও তার ব্র্যান্ডের বর্তমান অর্থমূল্য, শেয়ার বাজারে তার প্রতাপ, ‘রেভিনিউ জেনারেশন’ নিয়ে তার সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা, এ সব নিয়েও। এই সবই সমঝদারের পরিসর, কিন্তু যে কথাটি সাধারণ মানুষও বুঝতে পারবেন তা হল, ইউটিউব আসলে মানুষের অতি মৌলিক একটি প্রবণতাকে দোহন করেছে— তা হল ‘দেখা’ ও ‘দেখানো’। মানুষ সব সময়ই দেখতে চায়, অন্যের জীবনকে তুচ্ছাতিতুচ্ছ ক্ষুদ্র ও যারপরনাই বৃহৎ সমেত দেখার এক প্রবল আগ্রহ তার মধ্যে কাজ করে, এবং দেখতে দেখতেই তার মধ্যে আসে ‘দেখানো’র প্রণোদনাও। ইউটিউব এই জায়গাটিই ধরতে পেরেছে অত্যন্ত সফল ভাবে, খুলে দিয়েছে অষ্টপ্রহর দেখে চলার এক জঙ্গম দুনিয়া। চোখ থাকলেই দেখা যায় সত্য, তা বলে চাইলেই সব দেখা যায় না, অন্তত ডিজিটাল প্রযুক্তি ও আন্তর্জাল আসার আগে দেখা যেত না। ইউটিউবের নিহিত বার্তাটি যেন এই: জাতি গোষ্ঠী সমাজ ধর্ম রাজনীতি খাদ্য পোশাকআশাক বিনোদন এমনকি যৌনতার রকমফের— এই সব কিছু সমষ্টিজীবনে যত ভেদই করুক না কেন, এই সবই এবং আরও সব কিছুও যেন ব্যক্তি মানুষের ‘দেখা’ ও ‘শোনা’র বাইরে না থাকে। ইউটিউব মানুষের সহজাত সেই ‘দেখার অধিকার’কে প্রতিষ্ঠা দিয়েছে, মানুষ কী দেখবে তা নিয়ে কোনও বিচারসভা বসায়নি বরং সেই অধিকারকে করে তুলেছে রোজকার সহজ অভিজ্ঞতা, এখানেই তার কৃতিত্ব।
বাসে বা মেট্রোয় পথচলতি মানুষ স্মার্টফোনে আপনমনে একের পর এক ইউটিউব ভিডিয়ো উপভোগ করছেন, খাবার খেতে অনিচ্ছুক শিশুটির সামনে ইউটিউবের বিচিত্র ভিডিয়ো খুলে দিতেই সে বিনা বাক্যব্যয়ে খেয়ে নিচ্ছে— এই উদাহরণগুলিই বলে দেয়, শিশু থেকে বৃদ্ধ সকলের মনে ও জীবনে আজ এর কী প্রবল প্রভাব। এই প্রতাপ বাড়বে বই কমবে না: একটি ভিডিয়ো দেখতে দেখতে আজ ইউটিউবের অ্যালগরিদম উপভোক্তাকে পরের একটি ভিডিয়ো ‘সাজেস্ট’ করছে, দর্শকের কী পছন্দ মুহূর্তেই বুঝে নিয়ে তাকে প্রভাবিত ও চালিত করছে সমধর্মী ‘কনটেন্ট’-এর দিকে। এই যান্ত্রিক চতুরালি আসলে মানবিক ক্ষমতার উপরেই খোদকারি কি না, তাতে কোন বিপত্তি লুকিয়ে তা সময়ই বলবে। তবে মানুষের দেখতে চাওয়া আর দেখাতে চাওয়ার অভ্যাসটিও তো থাকবেই— তাই ইউটিউবের জয়যাত্রাও অব্যাহতই থাকার কথা।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)