E-Paper

অতিবিলম্বে অতি অল্প

ইতিমধ্যে জাতীয় নির্বাচন ঘটে গিয়েছে, বিভিন্ন রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচন ঘটেছে, আগামী নির্বাচনের প্রস্তুতি শুরু হয়েছে। নরেন্দ্র মোদী সারা দেশ সফর করেছেন, নির্বাচনী প্রচারে ব্যস্তসমস্ত হয়ে দেশভ্রমণ করেছেন। মণিপুরে আসেননি।

শেষ আপডেট: ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২৫ ০৫:১৮

ইম্ফল আর চূড়াচাঁদপুর থেকে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর বার্তা শোনা গেল, মণিপুর স্বাভাবিকতায় ফিরুক, তিনি ও তাঁরা পাশে আছেন। ‘পাশে থাকা’র অর্থ প্রধানমন্ত্রী কিছু অন্য রকম বোঝেন। ২০২৩ সালের মে মাসে মণিপুর রাজ্য চরম হিংসার মধ্যে নিমজ্জিত হয়ে পড়ার পর আটাশ মাস কেটেছে, এবং এই আটাশ মাস ধরে লাগাতার সেই হিংসা জারি থেকেছে— এত দিনে তিনি মণিপুরে এলেন। এত বড় হিংস্র জাতিগত সংঘর্ষ দেশবিদেশের সংবাদ শিরোনাম তৈরি করেছে, অথচ ভারতের প্রধানমন্ত্রী সেখানে পা রাখার অবকাশ পেলেন না। শুধু তা-ই নয়, মণিপুর বিষয়ে সংসদীয় আলোচনাও হয়েছে বহু বিলম্বে, এবং অতি অল্প পরিমাণে। ২০২৩ সাল থেকে কুকি জনগোষ্ঠীর নেতারা বারংবার প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক চেয়ে বিফল হয়েছেন, তাঁর ব্যস্ত কর্মতালিকায় সময় মেলেনি তাঁদের জন্য। অথচ, মেইতেই বনাম কুকি-জ়ো সংঘর্ষে ইতিমধ্যে ছারখার হয়ে গিয়েছে মণিপুরবাসীর বাসস্থান, জীবনযাপন। বহু প্রাণ গিয়েছে। বহু পরিবার ঘরছাড়া হয়েছেন, নির্যাতিত হয়েছেন। বহু নারী ধর্ষিত হয়েছেন। হিংসার মাত্রা এমন উচ্চতায় পৌঁছেছে যে, তা দেখে শিউরে উঠেছে গোটা দেশ। ইতিমধ্যে জাতীয় নির্বাচন ঘটে গিয়েছে, বিভিন্ন রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচন ঘটেছে, আগামী নির্বাচনের প্রস্তুতি শুরু হয়েছে। নরেন্দ্র মোদী সারা দেশ সফর করেছেন, নির্বাচনী প্রচারে ব্যস্তসমস্ত হয়ে দেশভ্রমণ করেছেন। মণিপুরে আসেননি। উত্তর-পূর্ব ভারতের দীর্ঘকালীন ক্ষোভ: দিল্লির রাজনৈতিক মহলের চোখে তার প্রান্তিকতা নিয়ে। গত দুই বছরের মণিপুর যেন এই প্রান্তিকতার একটি ‘কেস-স্টাডি’, ভয়ঙ্কর কাণ্ড ঘটলেও মূলস্রোতের রাজনীতি যে কতটাই উদাসীন থাকতে পারে তার লক্ষণীয় ও স্মরণীয় নিদর্শন। অবশেষে সেই সময় এল ১৩ সেপ্টেম্বর— সাকুল্যে তিন ঘণ্টা।

আটাশ মাস পর তিন ঘণ্টা। মণিপুরবাসী যদি ক্ষুব্ধ বোধ করেন, কিছু বলার থাকে না। এই সফরের মধ্যে প্রধানমন্ত্রী যে সব প্রতিশ্রুতি করলেন, তা শ্রুতিমধুর, তবে পরিস্থিতি তাতে কতখানি বদলাবে বলা মুশকিল। আইনশৃঙ্খলার উন্নতির প্রতিশ্রুতির সঙ্গে তিনি রাজ্যের সামাজিক প্রকল্পসমূহ ও পরিকাঠামোর উন্নতির প্রশংসা করলেন, বৃহৎ মাপের প্রকল্পের সূচনাও করলেন। পূর্ব অভিজ্ঞতা থেকে অবশ্য মণিপুর অন্যান্য পশ্চাৎপদ অঞ্চলের মতোই ভাল করে জানে যে, এ সব প্রতিশ্রুতি অধিকাংশ সময়েই অনুপলব্ধ থাকে, সূচনার পর প্রকল্প সহজেই পথভ্রষ্ট হয়।

তবে এর থেকে অনেক বড় কথা, মণিপুরে যে জাতিগত প্রতিদ্বন্দ্বিতা উত্তাল হয়ে আছে এখনও, তার সুরাহা একই রকম অনিশ্চিত রয়ে গেল আটাশ মাস পরেও। কুকিরা এখনও ইম্ফলে প্রবেশ করতে পারে না, মেইতেইরা ইম্ফলে বাইরে এখনও চূড়ান্ত অনিরাপদ বোধ করে। কুকি-জ়ো কাউন্সিলের দাবি, তাদের মূল্যবোধ ও আকাঙ্ক্ষা কোনও ভাবে রাজ্যে প্রতিফলিত হচ্ছে না, কুকি এলাকার চেয়ে মেইতেই ও নাগাদের জন্য অনেক বেশি বরাদ্দ করে রেখেছে কেন্দ্রীয় সরকার। তাই পৃথক বিধানসভা-সহ কেন্দ্রশাসিত কুকি অঞ্চলের ঘোষণা চায় তারা। বিপরীতে মেইতেইদের দাবি, অবিচার আসলে তাদের প্রতিই— সংরক্ষণের সুযোগ চায় তারা। মোদীর সফর নিয়েও মেইতেইদের একটি বড় অংশ বিরোধী ছিল— সফরের পরও সেই বিরোধিতা অক্ষুণ্ণ। এই তুমুল স্বার্থবিরোধিতার মূলগত সমাধান ছাড়া সঙ্কটের সুরাহা অসম্ভব। তদুপরি জটিলতা অনেক গুণ বাড়িয়েছে রাষ্ট্রপতি শাসনের মেয়াদ বৃদ্ধি। সেই সিদ্ধান্ত পাল্টে রাজ্যকে যথাসত্বর নির্বাচনের পথে নিয়ে আসা জরুরি। অথচ তেমন কোনও পদক্ষেপের চিহ্ন নেই, প্রধানমন্ত্রীর সফরেও রাষ্ট্রপতি শাসন প্রত্যাহার কবে তা নিয়ে কোনও উচ্চারণ শোনা গেল না।। কেন্দ্রকে বুঝতে হবে, অনেক দেরি হয়েছে, সমাজের সর্বস্তরের ক্ষোভের সামনে অতি সতর্ক কিন্তু অতি দ্রুত পদচারণা করতে হবে। সামান্য ভুলেও অসামান্য বিপদ আবারও মণিপুরকে গ্রাস করতে পারে।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Narendra Modi Prime Minister of India

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy