চার বছর ধরে প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখা বরাবর অচলাবস্থা কাটিয়ে গত বছরই লাদাখে সীমান্ত সমস্যার সমাধানের জন্য ঐকমত্যে আসে ভারত ও চিন। এর পরই দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক উন্নতির বিষয়ে একাধিক পদক্ষেপে আগ্রহ প্রকাশ করা হয় দু’তরফেই। গত মাসে ভারতীয় বিদেশসচিব বিক্রম মিস্রী-র চিন সফরকালে কৈলাস মানস সরোবর যাত্রা-সহ দু’দেশের মধ্যে সরাসরি বিমান সংযোগের আলোচনা হয়েছে। তবে ডিসেম্বরের শেষের দিকে লাদাখের কিছু অংশ নিজেদের বলে দাবি করে পুনরায় আঞ্চলিক বিতর্ক উস্কে দিয়েছে চিন। ফলে দ্বিপাক্ষিক কূটনীতির ৭৫তম বর্ষ উদ্যাপন কালেও দু’পক্ষ কূটনৈতিক সম্পর্ক মসৃণ রাখতে পারবে কি না, সে প্রশ্ন উঠছেই। লক্ষণীয়, গত বছর বিদেশমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর এক আলোচনাসভায় বলেছিলেন, ভূরাজনীতি একটি প্রতিযোগিতামূলক খেলা। দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম শক্তিশালী অর্থনীতি হওয়ার সুবাদে এই অঞ্চলে চিনের আধিপত্য বিস্তারের পরিকল্পনা স্বাভাবিক। ভারতেরও সেই কূটনৈতিক প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করা উচিত।
ভারতের পড়শি রাষ্ট্রগুলির উপরে যে প্রভাব বিস্তারের পরিকল্পনা করেছিল চিন, গত এক দশকে তাতে বহুলাংশেই সফল তারা। প্রভাব বিস্তার রাষ্ট্রের কাছে একটি কূটনৈতিক হাতিয়ার। মূলত বিনিয়োগ, ঋণ এবং অনুদানের মাধ্যমে পাকিস্তান, নেপাল, ভুটান, মায়ানমার, বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা এবং মলদ্বীপের মতো রাষ্ট্রের উপর প্রভাব বাড়িয়েছে চিন। শুধু তা-ই নয়, দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের ঐতিহ্যগত অর্থনৈতিক প্রভাবের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সম্প্রতি আঞ্চলিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রেও এক শক্তিশালী পক্ষ হিসেবে উঠে এসেছে। ভূরাজনৈতিক এবং ভূ-অর্থনৈতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা চরিতার্থ করতে তাদের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (বিআরআই) প্রকল্প চালু করার পর থেকে এই অঞ্চলের একাধিক দেশের সঙ্গে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি (এফটিএ) সম্পন্ন করেছে। বেজিং-এর ক্ষেত্রে এই চুক্তি শুধু সস্তায় রফতানিই নয়, দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশে তাদের বিআরআই প্রকল্পগুলি ত্বরান্বিত করতে এবং আর্থিক আনুগত্য গড়ে তুলতে সাহায্য করবে। একই সঙ্গে, সাম্প্রতিক কালে ইন্দো প্যাসিফিক অঞ্চলে তাদের সামরিক কার্যকলাপও অনেকাংশে বৃদ্ধি করেছে চিন। এর মাঝে মলদ্বীপ, নেপাল এবং শ্রীলঙ্কায় চিন মনোভাবাপন্ন সরকারের উত্থানের পাশাপাশি মায়ানমারের গৃহযুদ্ধ এবং বাংলাদেশের রাজনৈতিক অস্থিরতা দিল্লির ক্ষেত্রে পরিস্থিতি আরও জটিল করে তুলেছে। বলা যায়, চাপের চক্রব্যূহে বেজিং বেঁধে ফেলেছে দক্ষিণ এশিয়াকে।
আর্থিক প্রভাবের ক্ষেত্রে বেজিং-এর সঙ্গে পাল্লা দেওয়া যে অসম্ভব, তা বিলক্ষণ জানে দিল্লি। তাই বেজিং-কে ঠেকাতে এ-যাবৎ কূটনীতিকেই হাতিয়ার করেছে সে। সম্প্রতি কোয়াড গোষ্ঠীর সঙ্গে হাত মিলিয়ে ইন্দো প্যাসিফিক অঞ্চলে চিনের আধিপত্য প্রশমিত করতে সক্ষম হয়েছিল দিল্লি। তবে, ট্রাম্পের শাসনকালে আগামী দিনে দিল্লি সেই সহায়তা পাবে কি না, প্রশ্ন। যদিও চিনের ঋণের জালে জড়িয়ে শ্রীলঙ্কার তীব্র আর্থিক সঙ্কট বেজিং-এর কূটনৈতিক অভিপ্রায় স্পষ্ট করে দিয়েছে বাকি বিশ্বের কাছে। এ ক্ষেত্রে কলম্বোকে দিল্লির আর্থিক সহায়তাদান এক ইতিবাচক উদাহরণ: নিজের স্বার্থেই পড়শি রাষ্ট্রগুলির সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখার প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখা উচিত দিল্লির।
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)