স ংঘর্ষবিরতি হলেও সঙ্কটবিরতি দূর অস্ত্: ভারত ও পাকিস্তান এখনও প্রত্যহ পরস্পরের দাবি-প্রতিদাবি নিয়ে যুযুধান। তদুপরি, আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের পাঁচ দিনে পাঁচ বার উপর্যুপরি মন্তব্যেও দিল্লি স্বাভাবিক ভাবেই ব্যতিব্যস্ত। মঙ্গলবার ভারতের তরফে একটি ছয়-পয়েন্ট বক্তব্য প্রকাশিত— প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের যুদ্ধবিরতি বিষয়ক দাবিগুলির স্পষ্ট, দ্ব্যর্থহীন প্রত্যুত্তর সমেত। সেখানে ভারতের বিরুদ্ধে পরমাণু-আতঙ্ক ছড়ানোর দাবি, কাশ্মীর প্রশ্নে আমেরিকার মধ্যস্থতার দাবি, কিংবা এ নিয়ে নিরপেক্ষ বৈঠকের দাবি ইত্যাদি সজোরে উড়িয়ে প্রকৃতপক্ষে যে বিষয়টি ভারত সরকার প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছে— তা হল, বিশ্বমঞ্চে পাকিস্তানের সঙ্গে ভারতকে এক ‘হাইফেন’-এ রাখার প্রচেষ্টার বিরোধিতা। বুঝতে অসুবিধে নেই, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের আমেরিকা ও তৎসূত্রে পশ্চিমি শক্তিসমূহের কাছে এই ‘হাইফেন’ সুবিধাজনক কেননা ‘কুইক ডিল’ বা দ্রুত সন্ধির মাধ্যমে অর্থনৈতিক বিশ্ব-ব্যবস্থার গতি অব্যাহত রাখাই সে ক্ষেত্রে প্রধান লক্ষ্য। অন্য দিকে, ভারতের কাছে বিষয়টি অতীব গুরুতর, কেননা এই ‘হাইফেন’-প্রচেষ্টার মধ্যেই লুকিয়ে আছে দিল্লির একাধিক বিপদের ইশারা। এক, এর ফলে কাশ্মীর সমস্যার আন্তর্জাতিকীকরণের সম্ভাবনা নতুন করে তৈরি হচ্ছে, যা ভারতের স্বার্থবিরোধী হতে পারে। দুই, পরবর্তী কালে দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের কূটনৈতিক গুরুত্ব হ্রাসের সঙ্কেতও দৃশ্যমান। ফলে আমেরিকার সঙ্গে সন্ধিবন্ধনে আবদ্ধ হয়েও সেই আমেরিকারই কারণে ভারত এখন এক কঠিন সঙ্কটের মুখোমুখি, যেখানে প্রতি পদক্ষেপ সূক্ষ্ম বিবেচনাসাপেক্ষ।
প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সক্রিয়তা যখন প্রত্যহ শিরোনাম-আকর্ষী, তুলনায় কিছু প্রচ্ছন্ন ভাবে বহমান বেজিং-এর সমূহ তৎপরতা। একটি তথ্য ইতিমধ্যে বিতর্কোর্ধ্ব: পহেলগাম-উত্তর সংঘর্ষে আসলে পাকিস্তানের মাধ্যমে চিনের অস্ত্রসম্ভারেই কিছু পরিচয় মিলল। কিছু কিছু ধামাচাপা বিষয় ধামা খুলে বেরিয়েও এল। যেমন, ভারত পাকিস্তানের সংঘর্ষবিরতিকে চিন সমর্থন করলেও পাকিস্তানের পাশেই তারা শক্ত ভাবে দাঁড়িয়ে আছে এবং থাকবে। লক্ষণীয়, চলমান শতকে বাণিজ্য, প্রযুক্তি এবং পরিকাঠামোগত উন্নয়নে চিনের তুলনায় ভারতের উত্থান কিছুটা ধীর— তবু আমেরিকা ও পশ্চিমি জোটের নানা দেশের সঙ্গে সম্পর্ক-সূত্রে ভারত তার কৌশলগত স্বাতন্ত্র্য বজায় রেখেছে। বিশ্বমঞ্চে ভারতকে আর আঞ্চলিক খেলোয়াড় হিসেবে দেখা হয় না। এই কারণেই ‘গ্লোবাল সাউথ’ মঞ্চে ভারতের উত্থানকে আটকানো চিনের কাছে অতিআবশ্যক, যে প্রয়োজনবোধেরই নিশ্চিত অভিজ্ঞান— গত কয়েক বছরে পাকিস্তানের সঙ্গে চিনের সখ্য বৃদ্ধি, সামরিক সহযোগিতা, অর্থনৈতিক বিনিয়োগ এবং কূটনৈতিক সহায়তা, এই তিন লগ্নির মাধ্যমে। এই প্রয়াসে চিনের অন্যতম হাতিয়ার বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (বিআরআই), যার লক্ষ্য— এই অঞ্চলে ভারতের প্রভাববলয়ের অন্তর্গত দেশগুলিকে অর্থনৈতিক ও পরিকাঠামো সহায়তা দিয়ে— চিনের প্রভাব বৃদ্ধি। পাক ভূখণ্ডে ‘চায়না পাকিস্তান ইকনমিক করিডর’ (সিপিইসি) চিনকে মধ্য এশিয়ায় পৌঁছনোর বাণিজ্যগত ও কৌশলগত পথ খুলে দিতে পারে। অন্য দিকে, ইসলামাবাদকে নিজের উপর নির্ভরশীল করে আন্তর্জাতিক মঞ্চে চিন গুরুত্ব বাড়াতে পারে। ফলে ভারতের পূর্ব সীমান্তে যখন অরুণাচল প্রদেশের উপর চিনা অধিকার ফলানোর নিত্যনতুন প্রয়াস অব্যাহত, পশ্চিম সীমান্তে কাশ্মীর বিবাদে পাকিস্তান-‘মিত্র’ চিনের বিশেষ উৎসাহ সহজেই অনুমেয়। অবশ্য চিন-পাকিস্তানের ক্ষেত্রে মিত্রতা শব্দটি অনুপযুক্ত, বরং বলা যায় চিনের কাছে পাকিস্তান একটি প্রয়োজনীয় ‘বোড়ে’, যাকে এই অঞ্চলে ভারতীয় ক্ষমতার বিরুদ্ধে ভারসাম্য রাখার যন্ত্র হিসাবেই দেখতে চায় বেজিং। সুতরাং, এক যুদ্ধে আপাতত যবনিকাপাত হলেও ভারতের অন্য যুদ্ধটি প্রবল বেগে ধাবমান। ভারতের কূটনৈতিক দৃঢ়তার পরীক্ষা এখন— দিন আগত ওই।
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)