উৎসব মানেই যদি নতুন জিনিস, আর নতুন জিনিস মানেই যদি কেনাকাটা, তা হলে সরল সমীকরণ বলে, একুশ শতকের দ্বিতীয় দশকের মধ্যভাগে এসে অনলাইন শপিং উৎসবের চেহারাই দিয়েছে পাল্টে। দুই দশক আগে আলোচনার কেন্দ্রে ছিল শপিং মলের আবির্ভাব— ভাবা হত কেমন করে উৎসব ছবিটির রংবেরং তা পাল্টে দিচ্ছে। এ দিকে শপিং মল থেকে অনলাইন শপিং, অনেক দূরের রাস্তা, যদিও তা পরিভ্রমণ করতে লেগেছে নিতান্ত কম সময়। শপিং মল নামক বিস্ময়ের দিনেও পুজোর কেনাকাটা বলতে বাঙালি বুঝত সপ্তাহান্তে সময় করে বেরোনো। গড়িয়াহাট-হাতিবাগানের পাশাপাশি শহরের যেখানে শপিং মল আছে, সেই সব দিকে ভিড় ধাবিত হত, ঠাকুমা-দিদিমারা হতাশ ঔৎসুক্যে ভাবতেন কী সেই গন্তব্য যেখানে গেলে সব ইচ্ছার একত্র পূরণ সম্ভব, যাকে ছাড়া কেনাকাটা ভাবাই যায় না মোটে! অতি দ্রুত এমন সময়ও এসে গেল যখন সেই মহাসমারোহের শপিং মল আবার প্রায়শই ফাঁকা পড়ে থাকে, তার মপ-নিকানো চকচকে ফ্লোর— ক্রেতার আসার আশায় প্রহর গোনে। পরিবারের বড় থেকে ছোট, সকলেই এখন পুজোর শপিং বলতে আর মল-ভ্রমণ বোঝে না, বোঝে খাটে শুয়ে ফোনের স্ক্রিনে মনময়ূর নাচানো স্ক্রোল-শপিং। ছোটদের কাছে এই যেন চিরকালের স্বাভাবিক, আর বড়দের কাছে— অতি সুবিধাজনক, পরিশ্রম-কর্তক, উদ্বেগহারক। কিছু উদ্ভাবন এই ধরাধামে এসে যাওয়ার পর যেমন ভাবাই যায় না যে এই ধরাধাম এত দিন কী ভাবে এই বস্তুটি ছাড়া বেঁচেবর্তে ছিল— অনলাইন শপিং তেমনই এক উদ্ভাবন। এক আশ্চর্য জাদু। এক সর্বঝামেলাহন্তারক বন্দোবস্ত। উনিশ শতকের অবিস্মরণীয় বাঙালি রসরচনা হুতোম প্যাঁচার নকশা-র প্রবচনসম উক্তিটি ধার করে বলতে হয়— এই অ্যাক নূতন!
এই যে অনলাইন শপিং, যাকে গম্ভীর ভাষায় বলা হয় ই-কমার্স— তা কেবল শপিং-এর অভ্যাস পাল্টায়নি, কেনাকাটার বস্তুগুলিকেও অনেকাংশে পাল্টেছে। পথের পাঁচালী-র কালে যদি পুজোর সময়ে একটি জামা কোনও ক্রমে হত কি হত না, তার পরের সময়ে ঈষৎ-সম্পন্নতর বাঙালির জন্য পুজোর সময়ে জামার ছিট কিনে দর্জিসকাশে যাওয়া বোঝাত, তারও পরে রেডিমেড জামার সম্ভারে আত্মনিমজ্জন সহকারে পোশাক কেনায় মন দিত, এখন বিষয়টা গিয়েছে পাল্টে। এখন অনলাইনের যুগে, লেখার কলম থেকে রান্নার কড়াই, পায়ের খড়ম থেকে ঠোঁটের সিঁদুর (পরশুরামের ভাষায় লিপস্টিকের অপর নাম), ইস্ত্রি থেকে ফ্রিজ কিংবা এসি, সবই পুজোর বাজারের মধ্য স্বীকৃত। এই বিপুল বিশাল বহুধাবিস্তৃত বাজারবিশ্বে অর্থময় শব্দ কেবল ‘ডিসকাউন্ট’ আর ‘ডিল’— বিভিন্ন শপিং অ্যাপ ফোনের স্ক্রিনে এই দু’টি শব্দের ফোয়ারা ছুটিয়ে দেয় উৎসবের মরসুমে। সে দিক দিয়ে কিন্তু স্বাধীনতা দিবস, ক্রিসমাস আর পুজোর তেমন পার্থক্য নেই, দুর্গাপুজো আর দেওয়ালির মধ্যে তো নেই-ই। ফলে আগের মতো মহালয়া আসতে না আসতে সব বাজার সেরে ফেলারও কোনও বাধ্যতা নেই। যা রইল পড়ে, ফ্রাইং প্যান থেকে ফ্রিজিডেয়ার, সে সব আবার দেওয়ালি ডিসকাউন্টেই সহজলভ্য হয়ে যাবে। ফলে আজকের উৎসবের বাজারের অর্থ-অনর্থ দাবি করে অর্থশাস্ত্রের মনোযোগ। সে বাজার কি বেড়েছে? কমেছে? পরিসর পাল্টেও সে কি একই রকম উত্তেজক আছে? দ্রুত নতুন গবেষকরা আলোকক্ষেপণ করবেন এ দিকে, আশা রইল।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)