Advertisement
০২ মে ২০২৪
Paddy

তিক্ত ফসল

পশ্চিমবঙ্গ সরকার পঁচিশ লক্ষ চাষিকে নথিভুক্ত করে মোট পঁয়ষট্টি লক্ষ কুইন্টাল ধান কেনার লক্ষ্য নিয়েছিল।

paddy

—প্রতীকী ছবি।

শেষ আপডেট: ১৮ নভেম্বর ২০২৩ ০৫:৫৭
Share: Save:

সরকার সহায়ক মূল্যে ধান কিনতে চায়, দেওয়ার মতো চাষি খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। এ যেন উলটপুরাণ। বাজারের মূল্যের চাইতে সরকারি দর কুইন্টাল প্রতি অন্তত তিনশো টাকা বেশি, তাই সরকারকে ধান বিক্রির আগ্রহ চাষিদের মধ্যে বেশি হওয়ারই কথা। অতীতে কৃষি মান্ডিগুলির সামনে দীর্ঘ লাইন দেখা গিয়েছে। সহায়ক মূল্যে ধান বিক্রি করতে পারেননি বলে চাষিদের ক্ষোভও দেখা গিয়েছে বার বার। অথচ, এ বার চাষিই অমিল। পশ্চিমবঙ্গ সরকার পঁচিশ লক্ষ চাষিকে নথিভুক্ত করে মোট পঁয়ষট্টি লক্ষ কুইন্টাল ধান কেনার লক্ষ্য নিয়েছিল। নভেম্বরেই ধান কেনা শুরু হয়ে যায় প্রতি বছর। এ বারে দেখা যাচ্ছে, নভেম্বরের মাঝামাঝি পর্যন্ত দশ লক্ষ চাষিকেও নথিভুক্ত করা যায়নি। এর কারণ অর্থনীতিতে বা কৃষি উৎপাদনে খুঁজে লাভ নেই, এর কারণ দুর্নীতি। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের খাদ্য দফতরের ধান ক্রয়ের ব্যবস্থায় বিস্তর গলদ খুঁজে পাচ্ছে কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা ইডি। গ্রেফতার হয়েছেন প্রাক্তন খাদ্যমন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক, সরকারি ক্রয়ের শস্য ও টাকা আত্মসাৎ করায় অভিযুক্ত হয়েছেন রেশন ডিলার, চালকল মালিক এবং ধান ক্রয়ের সঙ্গে সংযুক্ত আধিকারিকরা। তার জেরে গোটা ব্যবস্থাটিই ধাক্কা খেয়েছে। সংবাদে প্রকাশ, চাষিদের দেওয়া তথ্য খুঁটিয়ে দেখে তবেই এ বছর আধিকারিকরা নাম নথিভুক্ত করছেন। ধরা পড়ছে বিস্তর গোলযোগ। অতীতে নথিভুক্ত একাধিক চাষির নামের সঙ্গে ছিল একই মোবাইল নম্বর, একই অ্যাকাউন্ট নম্বর। বহু চাষির নামের সঙ্গে সংযুক্ত জমির কাগজও যথাযথ নয়। অথচ, এমন ত্রুটিপূর্ণ নথির ভিত্তিতেই অতীতে চাষিদের অ্যাকাউন্টে ধান বিক্রির টাকা জমা পড়েছে। এক দিকে এই সব সন্দেহজনক নাম বাদ পড়ছে, অন্য দিকে চালকল মালিকরা চাষিদের নথিভুক্ত করাতে আগের মতো আগ্রহ দেখাচ্ছেন না। এই দুই ধাক্কার জেরে এক অভূতপূর্ব পরিস্থিতি দেখা দিয়েছে— খাদ্য দফতর ধান কিনতে চায়, বিক্রির জন্য চাষি খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।

এর ফলে দুর্নীতির শিকড় কত গভীর, ডালপালা কত দূর ছড়িয়েছে, তার একটা আন্দাজ পাচ্ছেন রাজ্যবাসী। নিজেরই বিধি মানতে গিয়ে রাজ্য সরকার যদি নথিভুক্তির লক্ষ্যের অর্ধেকেও পৌঁছতে না পারে, তা হলে বুঝতে হবে, বিধিভঙ্গই পশ্চিমবঙ্গে বিধি হয়ে দাঁড়িয়েছিল। এ রাজ্যে, তথা ভারতে, প্রশাসনিক কাজকর্মের কতখানি ব্যাহত করে দুর্নীতি, তার যথাযথ মূল্যায়ন হলে হয়তো বোঝা যেত, এতে ঠিক কত ক্ষতি হয়। মনে রাখতে হবে, কেবল টাকার অঙ্কে দুর্নীতিকে মাপা যায় না। যেমন, সম্প্রতি ইডি দাবি করেছে যে, রেশনের অন্তত ত্রিশ শতাংশ খাদ্যশস্য খোলা বাজারে বিক্রি হচ্ছিল পশ্চিমবঙ্গে। এর ফলাফল কেবল ওই চাল-আটার বাজারমূল্যেই নয়, হিসাব করতে হবে দরিদ্র পরিবারের অপুষ্টির মূল্যেও।

তেমনই, সহায়ক মূল্যে ধান ক্রয়ে দুর্নীতির হিসাব করতে হলে, কত ‘ভুয়ো’ চাষির অ্যাকাউন্টে টাকা গিয়েছে— কেবল সেই হিসাবই যথেষ্ট নয়। সরকারি ক্রয়ের আড়ালে ফড়েদের আধিপত্যই বজায় থাকার ফলে বাজারে ধানের দাম বাড়েনি, তার ফলে সামগ্রিক ভাবে চাষিদের ক্ষতি হয়েছে, এমন সম্ভাবনা যথেষ্ট। সেই বিপুল ক্ষতিরও হিসাব দরকার। আক্ষেপ, বিভিন্ন কৃষক সংগঠন, সংবাদমাধ্যম এবং বিরোধী নানা দল ধান ক্রয়ে দুর্নীতি নিয়ে বার বার প্রতিবাদ করা সত্ত্বেও, রাজ্য সরকার যথাযথ তদন্ত করেনি। সরকারের মন্ত্রী-আধিকারিকদের লালিত ‘সিন্ডিকেট’ দরিদ্র চাষির টাকা লুট করেছে, এই সন্দেহ সরকারের উপর আস্থাকে নষ্ট করেছে। তৃণমূল সরকারের দুর্নীতির অভিযোগ যে সম্পূর্ণ রাজনৈতিক প্রতিহিংসা-প্রসূত নয়, তা স্পষ্ট হচ্ছে। অথচ, শাসক দল নীরব। রাজনীতির তিক্ত ফসল উঠছে রাজ্যের গোলায়।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Paddy Farmers Corruption
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE