E-Paper

সত্য থেকে অ-সত্যে

সম্প্রতি জম্মু ও কাশ্মীরের প্রাক্তন রাজ্যপাল সত্যপাল মালিকের বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে সত্য গোপন করার অভিযোগ উঠে এল।

শেষ আপডেট: ২০ এপ্রিল ২০২৩ ০৬:০১
Narendra Modi and Satya Pal Malik.

প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এবং জম্মু ও কাশ্মীরের প্রাক্তন রাজ্যপাল সত্যপাল মালিক। ফাইল চিত্র।

রাজনীতিতে সত্য কথনের কোনও দায় নেই, এত দিনে ভারতীয় গণতন্ত্রে সে কথা যথেষ্ট পরিমাণে প্রতিষ্ঠিত। কিন্তু নরেন্দ্র মোদী সরকারের আমলে ‘সত্য’ বিষয়টি যে ভাবে নিতান্ত এলেবেলে, ঠাট্টাতামাশার বস্তু হয়ে দাঁড়িয়েছে, তেমনটা আগে কখনও ঘটেছে কি? প্রধানমন্ত্রী নিজে সম্ভবত কোনও বিষয়ে স্পষ্ট তথ্য এবং সত্য নাগরিকের কাছে পেশ করা জরুরি বলে মনে করেন না। গত ন’বছর ধরে তাঁর মন্ত্রিসভা এবং সরকারও তাঁর প্রদর্শিত পথ ধরে চলেছে। ২০১৪ সাল থেকে বিভিন্ন বিষয়ে সত্যের সঙ্গে কেন্দ্রীয় সরকারের এই প্রকাশ্য আড়াআড়ি দেখে আসছেন ভারতবাসী— নোটবন্দি থেকে গলওয়ানে চিনা আক্রমণ, কিংবা আদানি বিতর্ক থেকে শুরু করে পুলওয়ামার জওয়ান নিধন— কোনও বিষয়েই আসল ঘটনা স্পষ্ট করে বলার দায়িত্ব বর্তমান সরকার স্বীকার করেনি, বিরোধী রাজনীতির মঞ্চ কিংবা নাগরিক সমাজ থেকে দাবি উঠলে উপেক্ষার ফুৎকারে তা উড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।

এই পরিপ্রেক্ষিত মনে রেখেও বলতে হয় যে, সম্প্রতি জম্মু ও কাশ্মীরের প্রাক্তন রাজ্যপাল সত্যপাল মালিকের বক্তব্যে যে ভাবে প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে সত্য গোপন করার অভিযোগ উঠে এল, ২০১৯ সালে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের ঘোর দায়িত্ব-স্খলনের বিষয়টি গোপন করার নির্দেশ খোদ প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে এসেছিল বলে শোনা গেল— তার পরও মোদী এবং তাঁর সরকারের দিক থেকে গোটা বিষয়টির প্রতি অবজ্ঞা ও উপেক্ষা প্রদর্শনের এই সরকারি স্পর্ধা আগেকার সব দৃষ্টান্তকে ছাপিয়ে যায়। এই ঘটনা কেবল নরেন্দ্র মোদী সরকারের চরিত্রচিত্রণ করে না, ভারতীয় গণতন্ত্র কোন প্রবল দুর্দশা এবং হীনতায় পতিত হয়েছে, তার অভিজ্ঞান উন্মোচিত করে। বিশেষত এমন কথা মনে করার প্রভূত কারণ আছে যে, ২০১৯ সালে পুলওয়ামার ঘটনায় চল্লিশ জন সশস্ত্র জওয়ানের মৃত্যুর সঙ্গে ঠিক তার দু’মাস পরে জাতীয় নির্বাচনের ফলাফলের এক গভীর যোগ ছিল; সুতরাং এ আর কেবল সাধারণ নৈতিকতার বিষয় হয়ে থাকে না, গণতন্ত্রের মৌলিক স্খলনের প্রশ্ন হয়ে দাঁড়ায়। আজ সত্যপাল মালিকের মুখে এই কথা উঠে আসায় যখন সরকার পক্ষ থেকে বলা হয় যে তাঁর কথা ধর্তব্য নয়, তখন মোদী সরকারের সত্য-বিরোধী স্বরূপটি স্পষ্ট হয়ে যায়। এমন ধর্তব্য-অতীত মানুষটিকে জম্মু ও কাশ্মীরের মতো গুরুত্বপূর্ণ রাজ্যের দায়িত্ব তাঁরাই দিয়েছিলেন। আজ তাঁরাই সেই কাজের বেলা কাজি-কে কাজ ফুরালে (এবং মুখ খুললে) অকাজের মানুষ বলে দাগিয়ে দিচ্ছেন।

কী ঘটেছিল পুলওয়ামায়? যা বলছেন সত্যপাল মালিক, তার কতটা ঠিক, কতটা নয়? প্রমাণ হিসাবে সরকার কী তথ্য দিতে পারে? পরিচিত নীরবতার কৌশল দিয়েই যদি এত গুরুতর প্রসঙ্গটি মোদী সরকার চাপা দেওয়ার চেষ্টা করে, তার অর্থ কি এই দাঁড়ায় না যে— সত্যটি আসলে এমন যা উদ্ঘাটন করার ‘উপায়’ কিংবা ‘সামর্থ্য’ এই সরকারের নেই? সঙ্গে সঙ্গে এও স্পষ্ট যে, ভারতীয় গণতন্ত্রের এমনই টুঁটি-টেপা দশা যে বিরোধী রাজনীতির পক্ষে এত বড় গুরুতর প্রশ্নেও সরকারের উপর চাপ তৈরি করা সম্ভব নয়, এবং গোটা দেশের জনসমাজের কাছে জাতীয় সেনাবাহিনীর জওয়ান-নিধনে জাতীয় সরকারের সম্ভাব্য দায়িত্বের প্রশ্নটি আদৌ ‘এত বড় গুরুতর প্রশ্ন’ নয়! নানাবিধ কলাকৌশলের মাধ্যমে বিরোধী নেতাদের অসক্রিয় করে দেওয়ার বন্দোবস্ত এত দিনে পরিচিত, কিন্তু বৃহত্তর জনসমাজেও যদি জাতীয় নিরাপত্তার মতো বিষয় কোনও তরঙ্গ না তুলতে পারে, তাতে গণতন্ত্রের সার্বিক ব্যর্থতা প্রমাণিত হয়। তবে, গণতন্ত্র নিয়ে মাথাব্যথাটিও বোধ করি এত দিনে বিগত বিলীয়মান ঐতিহ্যে পরিণত হয়েছে— শাসক কিংবা শাসিত, কেউই নিজ নিজ মস্তককে খামোকা ‘ব্যথিত’ করতে চান না।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Satya Pal Malik Narendra Modi

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy