E-Paper

বৃক্ষহীন

যশোর রোডে প্রাচীন বৃক্ষগুলির সম্ভাব্য ছেদন নিয়ে নাগরিক প্রতিবাদ হচ্ছে, খাস মহানগরে সবুজের মুছে যাওয়াও সমান উদ্বেগের।

শেষ আপডেট: ২৪ এপ্রিল ২০২৩ ০৬:১৬
trees.

বৃক্ষ এমনিতেই মূল্যবান, এই প্রাচীন মহাবৃক্ষেরা আরও মূল্যবান। ফাইল চিত্র।

নিষ্ঠুর নিদাঘে পুড়ছে শহর কলকাতা, এত দিনে মানুষ বুঝছে সবুজের গুরুত্ব, গাছেদের গুরুত্ব, ছায়ার গুরুত্ব। ১৮ এপ্রিল বিশ্ব ঐতিহ্য দিবসের উদ্‌যাপন অনুষ্ঠানে পশ্চিমবঙ্গ জীববৈচিত্র পরিষদের প্রধান আধিকারিক গাছ নিয়ে যে কথাগুলি বললেন, এ শহর মন দিয়ে শুনলে কাজে দিত। দক্ষিণ কলকাতার কয়েকটি অঞ্চলের ঘন সবুজ অংশগুলিকে জীববৈচিত্রের ‘হটস্পট’ হিসাবে চিহ্নিত করে তাদের সংরক্ষণ করা যায় কি না, এ প্রশ্নের উত্তরে তিনি যা বললেন তার মর্মার্থ, মহানগরেই হোক কি গ্রামে-মফস্‌সলে, এ রাজ্যের যেখানেই দু’শো বছর বা তারও বেশি প্রাচীন বৃক্ষেরা ডালপালা মেলে দাঁড়িয়ে আছে, তাদের প্রত্যেককে চিহ্নিত করে সংরক্ষণ করা দরকার ‘ঐতিহ্য’ হিসাবে। তারা হতে পারে বটগাছ, পাকুড়, গাব, এমনকি কামরাঙা, আঁশফল বা ফলসা গাছও। রাজ্যের মোট ৩৪২টি ব্লকের প্রতিটিতে এ ভাবে যদি একটি করেও মহাবৃক্ষকে চিহ্নিত ও সংরক্ষণ করা যায়, পশ্চিমবঙ্গ হয়ে উঠবে তিনশোরও বেশি প্রাচীন বৃক্ষ-ঐতিহ্যের আশ্রয়ভূমি এক রাজ্য।

বৃক্ষ এমনিতেই মূল্যবান, এই প্রাচীন মহাবৃক্ষেরা আরও মূল্যবান— কারণ তাদের ঘিরে গড়ে ওঠে জীববৈচিত্রের এক-একটি বিরাট বিপুল পরিসর, পাখি প্রজাপতি পিঁপড়ে কীট পতঙ্গ কেঁচো কাঠবেড়ালি-সহ অগণিত প্রাণ নিয়ে। সেই প্রচলকথাটি মনে পড়তে পারে: একটি পাখি আর কাঠবেড়ালিকে পোষ মানাতে বাড়ি নিয়ে এলেও দু’জনেই পালিয়ে গেল, কিন্তু যেই না একটা গাছ লাগানো হল, দু’জনেই এক দিন ফিরে এল আনন্দে, স্বেচ্ছায়। এ আসলে জীববৈচিত্রেরই গল্প, যার কেন্দ্রে রয়েছে এক বৃক্ষ। জলবায়ু পরিবর্তনের ফাঁস যতই চেপে বসছে পৃথিবীর উপরে, উন্নত বিশ্বের শহরগুলিতে নগর-পরিকল্পনাবিদ ও পরিবেশবিদরা ততই জোর দিচ্ছেন শহরের প্রাচীন গাছেদের উপস্থিতি ও অস্তিত্ব নিশ্চিত করার কাজে, তাদের সংরক্ষণ ও প্রযত্নের উপরে— কারণ শহর শুধুই মানুষের বাসস্থান নয়, হতে পারে না কখনও। উদ্ভিদ ও প্রাণীর বৈচিত্রময় সহাবস্থান ছাড়া মানুষের ‘নাগরিক’ জীবন অসম্পূর্ণ এবং ক্ষতিকর। এই সহাবস্থানকেও হতে হবে যথাসম্ভব প্রাকৃতিক, সরকার বা পুর প্রশাসনের গড়া কৃত্রিম ও অপরিকল্পিত ‘বায়োডাইভার্সিটি পার্ক’গুলির পক্ষে তাই একটি প্রাচীন গাছের জীববৈচিত্রের বিকল্প হয়ে উঠতে পারা প্রায় অসম্ভব।

অথচ বাগবাজার থেকে গড়িয়া, সল্টলেক থেকে বেহালা— কলকাতা থেকে এই প্রাচীন গাছেরা হারিয়ে যাচ্ছে ক্রমশ। অতি প্রাচীন গাছ তো অনেক পরের কথা, একটু বেশি ডালপালা মেলা গাছেরাই এ শহরে পুর প্রশাসন থেকে শুরু করে সাধারণ নাগরিকেরও চক্ষুশূল। ঘূর্ণিঝড়ের আগাম পূর্বাভাসেও এ শহরে বড় গাছেদের কেটে ফেলা হয়, দুর্গাপূজার আগেও, কারণ তারা মানুষের অসুবিধার কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। সাধারণ নাগরিক স্রেফ প্রতিবেশীর সঙ্গে মনান্তর এড়াতে বাড়ির চৌহদ্দির বড় গাছ কেটে ফেলেন। বহু আবাসন নির্মাণকারী বেসরকারি সংস্থা তাদের তৈরি বহুতলের বিজ্ঞাপনে তুলে ধরেন সুদৃশ্য পার্কের সমারোহ, খোঁজ নিলে দেখা যাবে মূল জমিটি একদা ছিল সবুজে ভরা। যশোর রোডে প্রাচীন বৃক্ষগুলির সম্ভাব্য ছেদন নিয়ে নাগরিক প্রতিবাদ হচ্ছে, খাস মহানগরে সবুজের মুছে যাওয়াও সমান উদ্বেগের। নইলে শহরের উষ্ণতম দিনে কোথাও এতটুকু ছায়া মিলবে না।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Trees Environment

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy