Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪
New Years Resolution

প্রতিজ্ঞা

মানুষের ইচ্ছাশক্তি নির্ভর করে মগজের ব্যান্ডউইথ বা ধারণক্ষমতার উপর। মাথার উপর যত চাপ বাড়ে, ততই ক্ষীণ হতে থাকে ইচ্ছাশক্তি।

আরও এক বার প্রতিজ্ঞা ও প্রতিজ্ঞাভঙ্গের পর্ব।

আরও এক বার প্রতিজ্ঞা ও প্রতিজ্ঞাভঙ্গের পর্ব। প্রতীকী ছবি।

শেষ আপডেট: ০৮ জানুয়ারি ২০২৩ ০৫:০০
Share: Save:

নতুন বছরের প্রথম সপ্তাহটি অতিক্রান্ত। সম্ভবত অনেকেরই নববর্ষের প্রতিজ্ঞারও মেয়াদ ফুরিয়েছে। নিয়মিত শরীরচর্চা করা, বেহিসাবি খরচে রাশ টানা, সময়মতো পড়তে বসা অথবা ধূমপানের অভ্যাস ত্যাগ করা— বছরের শেষ রাতে পরের বছর থেকে মেনে চলার জন্য যত প্রতিজ্ঞা করে মানুষ, পরিসংখ্যান বলছে যে, তার আশি শতাংশই প্রথম সপ্তাহের গণ্ডি পার করতে পারে না। ভাল হওয়া বড়ই কঠিন! প্রশ্ন হল, কেন? এই প্রশ্নের উত্তর একাধিক। সুঅভ্যাস গড়ে তোলার অর্থ হল, পুরনো কোনও কুঅভ্যাস ত্যাগ করা— ধূমপান বন্ধ করা, আলস্য ছেড়ে জিমের পথ ধরা ইত্যাদি। পুরনো অভ্যাস ত্যাগ করতে ইচ্ছাশক্তির প্রয়োজন হয়, এই কথাটা আলাদা করে বলা নিতান্তই বাহুল্য হবে। কিন্তু, ইচ্ছাশক্তির ভান্ডারটি যে অফুরান নয়, সে কথা সম্ভবত ততখানি স্বতঃসিদ্ধ নয়। মানুষের ইচ্ছাশক্তি নির্ভর করে মগজের ব্যান্ডউইথ বা ধারণক্ষমতার উপর। মাথার উপর যত চাপ বাড়ে, ততই ক্ষীণ হতে থাকে ইচ্ছাশক্তি। বছরের প্রথম দিনটির আনন্দ-ফুর্তিতে যে প্রতিজ্ঞাকে সহজসাধ্য বোধ হয়, সপ্তাহ না ঘুরতেই জীবনের অজস্র চাপে পূরণ করা দুষ্কর হয়ে ওঠে। বহু অভ্যাসের সঙ্গে সরাসরি যোগ রয়েছে স্নায়বিক রাসায়নিকেরও। মগজের ইচ্ছাশক্তি যখন কমে— পরিভাষায় যাকে ইগো ডিপ্লেশন বলা হয়— তখন সেই রাসায়নিকের অভাবজনিত তাড়নাকে সামাল দেওয়াও কঠিন হয়ে ওঠে। ফলে, প্রতিজ্ঞাভঙ্গই একমাত্র পরিণতি হয়ে দাঁড়ায়। মানুষ ফের পরের নববর্ষের অপেক্ষায় থাকে— আরও এক বার প্রতিজ্ঞা ও প্রতিজ্ঞাভঙ্গের পর্ব।

অর্থশাস্ত্রের দুনিয়ায় হোমো ইকনমিকাস বা অর্থনৈতিক মানব বলে একটি ধারণা বহুলপ্রচলিত। এই অর্থনৈতিক মানব অসীম ক্ষমতাসম্পন্ন— সে প্রতিটি সিদ্ধান্ত নেয় তার চূড়ান্ত লক্ষ্যের কথা মাথায় রেখে; প্রতিটি ধাপে সব সম্ভাব্য সিদ্ধান্তের তুল্যমূল্য বিচার করতে পারে; কোনও ‘মানুষী দুর্বলতা’য় অকাতরে প্রলয়ের পথ ছেড়ে দেওয়া তার ধর্ম নয়। অর্থশাস্ত্র মানুষকে এমন চূড়ান্ত র‌্যাশনাল এক সত্তা হিসাবে কল্পনা করে। সেই সত্তাটি যদি বাস্তব হত, তা হলে নতুন বছরের প্রতিজ্ঞা রক্ষা করা কারও পক্ষেই বিন্দুমাত্র কঠিন হত না, কারণ নতুন বছরের প্রতিজ্ঞাগুলি চরিত্রে এমনই, যা আমাদের দীর্ঘমেয়াদি কল্যাণের পথে নিয়ে যায়। কিন্তু, বাস্তবের মানুষ চালিত হয় বিভিন্ন আবেগ, অনুভূতি, যুক্তিহীন তাড়নায়। অবসর জীবনের জন্য টাকা জমানো অতি প্রয়োজনীয়, তা জানার পরও মানুষ হঠাৎ হাতে আসা টাকা উড়িয়ে দিতে পারে কোনও শখ পূরণ করতে।

শিবরাম চক্রবর্তী নাকি এক জনকে তাঁর দৈনিক রুটিন শুনিয়েছিলেন— মূলত ঘুমে ঠাসা সেই রুটিনে লেখালিখির কোনও উল্লেখ নেই দেখে সেই ব্যক্তি জানতে চেয়েছিলেন, তা হলে লেখেন কখন? শিবরাম উত্তর দিয়েছিলেন, “কেন, পরের দিন!” কথাটি প্রায় দার্শনিকের, কারণ ‘পরের দিন’ করব বলে কাজ রেখে দেওয়ার অভ্যাসটি সম্ভবত মানুষের ডিএনএ-তে গাঁথা রয়েছে। নতুন বছরের প্রতিজ্ঞাও ‘কাল থেকে পালন করব’ বলে কিছু দিন ফেলে রাখার পর, তাতে কিঞ্চিৎ ধুলো জমলে মানুষ তা সহজে ভুলে যায়। প্রশ্ন হল, এই চক্র থেকে নিস্তারের পথ আছে কি? আচরণবাদী অর্থশাস্ত্রের তত্ত্ব বলছে, বিলক্ষণ আছে। প্রথম ধাপ হল, যে কোনও একটা প্রতিজ্ঞা বেছে নেওয়া প্রয়োজন। কার্যত সকলেরই একাধিক ক্ষেত্রে উন্নতি করা প্রয়োজন, কিন্তু সেই চেষ্টাকে একাধিক বছরে ভাগ করে নেওয়াই বিধেয়— এক দিকে মন দিলে তবু মন দেওয়ার উপায় থাকে। দ্বিতীয়ত, কেন পরিবর্তনটি চাই, সেই উত্তর নিজের কাছে স্পষ্ট হওয়া জরুরি। তৃতীয় শর্ত হল দায়বদ্ধতা। মানুষ সাধারণত নিজের প্রতি অত্যন্ত সদয়, ফলে প্রতিজ্ঞায় ফাঁকি দেওয়ার যে অজুহাতগুলি মন খাড়া করে, সেগুলিকে নির্বিচারে সত্য ভেবে তাকে মেনে নিতেও মন সদাপ্রস্তুত। কাজেই, কোনও তৃতীয় পক্ষকে হিসাবরক্ষকের দায়িত্ব দিলে প্রতিজ্ঞা পালনের কাজটি সহজতর হতে পারে। দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্য স্থির করার বদলে প্রতি সপ্তাহের বা প্রতি মাসের লক্ষ্য স্থির করলেও ভাল ফল পাওয়ার সম্ভাবনা। ইতিহাস বলছে, নতুন বছরের প্রতিজ্ঞার রেওয়াজটি হামুরাবির আমল থেকে চলছে। অর্থাৎ, প্রায় চার সহস্রাব্দ ধরেই মানুষ নিজের উন্নতিসাধনের প্রতিজ্ঞা করছে, এবং তা পালনে ব্যর্থ হচ্ছে। কিন্তু, সেই ব্যর্থতাই শেষ কথা নয়। যাঁরা মনের রাশ ধরতে জানেন, তাঁদের সাফল্যের ইতিহাসও সম্ভবত চার হাজার বছরের প্রাচীন।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

New Years Resolution Health Human Psychology
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE