Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪
Newspaper

সাধু থেকে চলিত

যে ভাষা অনেক দিন আগেই ইতিহাস হয়ে গিয়েছে, শতাব্দী পেরিয়ে এসে আনন্দবাজার পত্রিকা-ও আজ তাকে ইতিহাসের পাতায় সসম্মান স্থান দিল।

শেষ আপডেট: ১৮ মার্চ ২০২২ ০৬:৪১
Share: Save:

অগ্রসর হওয়া মানে ইতিহাসকে অস্বীকার করা নয়, ইতিহাসের জমিতে পা রেখে, তার গতি ও প্রকৃতিকে মর্যাদা দিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়া। সেই অগ্রগতি চিন্তায় এবং ধারণায়, আবার তা প্রকাশের ভাষাতেও। আনন্দবাজার পত্রিকা-র ভাষাশৈলীতেও এই বিবর্তনের উজ্জ্বল স্বাক্ষর। ১৯৬৫ সালের মার্চ মাসের মাঝামাঝি পত্রিকায় চলিত ভাষায় সংবাদ প্রতিবেদন লেখা শুরু হয়। প্রথম দিকে কিছু দিন দুই ভাষারীতি পাশাপাশি চলেছিল— কিছু রিপোর্ট পুরনো মতে সাধু ভাষায়, কিছু নবাগত চলিত ভাষায়। অচিরেই এই সংবাদপত্রে চলিত ভাষা সর্বত্রগামী হয়, একটি ব্যতিক্রম ছাড়া। এই সম্পাদকীয় স্তম্ভের ভাষায় সাধু গদ্যরীতিই বহাল থাকে।

সম্পাদকীয় প্রবন্ধে সাধুভাষা বজায় রাখার পক্ষে একাধিক যুক্তি ছিল; তাত্ত্বিক যুক্তি এবং প্রায়োগিক যুক্তি, দুই-ই। প্রথমত, এই ভাবে ঐতিহ্য এবং আধুনিকতার মধ্যে একটি যোগসূত্র ধরে রাখা যায়, দৈনিক সংবাদপত্রের নিরন্তর প্রবহমানতাকে সাধুগদ্যে লিখিত সম্পাদকীয় প্রবন্ধের শৃঙ্খলায় পরিচালনা করা যায়। দ্বিতীয়ত, সম্পাদকীয় স্তম্ভে জানানো হয় সংবাদপত্রের নিজস্ব প্রাতিষ্ঠানিক মতামত ও দৃষ্টিভঙ্গি। জনমত গঠনে তার একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকে। সাধুভাষা সেই গুরুত্বের ধারক ও বাহক হিসাবে বিশেষ উপযোগী। কেবল সমাজে প্রচলিত ভাষা নয়, সংবাদপত্রের অন্যত্র যে ভাষা লেখা হচ্ছে তার থেকেও নিজেকে স্বতন্ত্র রাখার ফলে পাঠকের চেতনায় সম্পাদকীয় প্রবন্ধের একটি স্বকীয় অবস্থান তৈরি হয়। তৃতীয়ত, প্রয়োগের দিক থেকে সাধুভাষা ব্যবহারের পক্ষে যুক্তি ছিল এই যে, বিভিন্ন বিষয়ে তীক্ষ্ণ মন্তব্য, বিশেষত সূক্ষ্ম ব্যঙ্গ বা তিরস্কারের পক্ষে এই গদ্যরীতি বিশেষ উপযোগী— বঙ্কিমচন্দ্র থেকে রাজশেখর বসু বা নীরদচন্দ্র চৌধুরী অবধি তার বহু উজ্জ্বল নিদর্শন বাংলা ভাষায় আছে। সম্পাদকীয় প্রবন্ধে এই ধরনের প্রয়োগ প্রায়শই মূল্যবান।

অন্য দিকে, সময় এবং বাস্তবের সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তনের স্বাভাবিক দাবিকে স্বীকৃতি দেওয়ার যুক্তিও খুবই বড় যুক্তি। বাস্তব সত্য এই যে, বাংলা ভাষার কথিত এবং লিখিত রূপ এখন সাধুগদ্যের শৈলী থেকে এতটাই দূরে চলে এসেছে যে বহু পাঠকের কাছে সাধুভাষা হয়তো কেবল অপরিচিত নয়, দুষ্পাঠ্য বলেও মনে হয়। এ কথা মনে করার কারণ আছে যে, অনেকেই শুধু এই ভাষাগত দূরত্বের কারণেই সম্পাদকীয় প্রবন্ধ পড়ে উঠতে পারেন না, অথবা পড়ার উৎসাহ পান না। সংবাদপত্রের পক্ষে সেটা দুর্ভাগ্যের কারণ। বস্তুত, এমন বাস্তবের পরোক্ষ স্বীকৃতি আছে এই স্তম্ভেই— তার সাধুভাষার চরিত্রে কালক্রমে বিস্তর পরিবর্তন ঘটেছে, সহজ কথায় বলা যায় যে সম্পাদকীয় প্রবন্ধের সাধুভাষা ক্রমশই চলিত ভাষার অনেক কাছে চলে এসেছে। এই পরিপ্রেক্ষিতেই, চলমান সময় ও তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে পরিবর্তনশীল সামাজিক ভাষারীতিকে স্বীকৃতি দিয়ে, সম্পাদকীয় প্রবন্ধে সাধু গদ্যশৈলীর বদলে চলিত গদ্যশৈলী প্রবর্তন করা কেবল দরকারি নয়, জরুরি হয়ে পড়েছে। সাধুভাষাকে অশ্রদ্ধা বা অস্বীকার করার কোনও প্রশ্ন নেই, কিন্তু যে ভাষা অনেক দিন আগেই ইতিহাস হয়ে গিয়েছে, শতাব্দী পেরিয়ে এসে আনন্দবাজার পত্রিকা-ও আজ তাকে ইতিহাসের পাতায় সসম্মান স্থান দিল।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Newspaper
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE