আগুন লাগিয়াছে বাজারে। মূল্যবৃদ্ধির আগুন। সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত অক্টোবরে পাইকারি বাজারে মূল্যবৃদ্ধির হার ছিল ১২.৫৪ শতাংশ। পাঁচ মাসে যাহা সর্বোচ্চ। যদিও গত সাত মাস ধরিয়াই পাইকারি মূল্যবৃদ্ধির হার রহিয়াছে ১০ শতাংশের উপরে। প্রসঙ্গত, মে মাসে ইহা ছিল ১৩.১১ শতাংশ। মূল্যবৃদ্ধির কারণ বহুবিধ। প্রথমত, দেশি-বিদেশি বাজারে কাঁচামালের আগুন দর ও অপ্রতুলতা উৎপাদন শিল্পকে বিপাকে ফেলিয়াছে। বেশ কিছু ক্ষেত্রে উৎপাদনের জন্য ভারত কাঁচামাল বা অন্তর্বর্তী পণ্য বিদেশ হইতে আমদানি করিয়া থাকে। তাহার মূল্যবৃদ্ধি দেশের বাজারে আগুন লাগাইয়াছে। যেমন, সেমিকন্ডাকটর বা চিপের অভাব প্রভাবিত করিয়াছে গাড়ি, যন্ত্রপাতি হইতে শুরু করিয়া মোবাইল, টেলিভিশন ইত্যাদির উৎপাদন। দ্বিতীয়ত, কয়লার জোগানে ঘাটতি হওয়ায় জ্বালানি এবং বিদ্যুৎ উৎপাদনে তাহার প্রভাব লক্ষণীয়। দাম বাড়িয়াছে বিদ্যুতের। ফলে কলকারখানায় উৎপাদনের খরচ বাড়িতেছে। ডলারের তুলনায় টাকার দামও নিম্নমুখী, রফতানির ক্ষেত্রে যাহা অতিরিক্ত মূল্যবৃদ্ধি ঘটাইয়াছে। অন্য দিকে, পেট্রল ও ডিজ়েলের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধিও সামগ্রিক মূল্যস্তরকে ঠেলিয়া তুলিয়াছে— ফলে বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য কিনিতে গিয়া নাভিশ্বাস উঠিতেছে সাধারণ মানুষের। তাহার উপর, বিভিন্ন কারণে ফসল নষ্ট হইয়াছে, মজুতদারিও হইয়াছে। সব মিলাইয়া সমস্যা বাড়িয়াছে।
অর্থনীতিবিদরা সাক্ষ্য দিবেন যে, মূল্যস্ফীতির চাকা এক বার গড়াইতে শুরু করিলে তাহাকে নিয়ন্ত্রণ করা অতি কঠিন। ইউপিএ আমলে যে বিজেপি নেতারা পথঘাট কাঁপাইয়া মূল্যস্ফীতির বিরুদ্ধে আন্দোলন করিতেন, ক্ষমতায় আসীন হইয়া তাঁহারাও এই সত্যটি হাড়ে হাড়ে বুঝিতেছেন। তবু, কিছু পদক্ষেপ করা সম্ভব। দেশের অর্থনীতিকে চাঙ্গা করিতে রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্ক ক্রমশ সুদের হার কমাইয়াছে। সেই সিদ্ধান্তের অর্থনৈতিক যুক্তি বিলক্ষণ আছে, কিন্তু তাহাতে মূল্যবৃদ্ধি বাড়িবারও ভয় থাকিয়া যায়। সুদের হার নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে মূল্যস্ফীতির প্রসঙ্গটিকেও স্মরণে রাখা অবশ্যকর্তব্য। আর্থিক বৃদ্ধি ও মূল্যস্ফীতির মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখিবার দায়িত্ব রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কের। অন্য দিকে, তেলের উপরে রাজস্ব চড়া রাখিবার ফলে জ্বালানি তেলের দাম বিপুল পরিমাণে বাড়িয়াছে। মাঝে কেন্দ্রীয় সরকার উৎপাদন শুল্কের পরিমাণ খানিক কমানোয় তেলের দাম কিছুটা কমিয়াছে বটে, কিন্তু তাহা যথেষ্ট নহে। কারণ তেলের উপরে যে হারে রাজস্ব সরকার আদায় করিতেছিল, তাহা চাপ ফেলিতেছে অর্থনীতির উপরেই। রাজস্ব কমাইবার যে সাম্প্রতিক পদক্ষেপ সরকার করিয়াছে, তাহা আরও পূর্বেই করা উচিত ছিল। অন্য দিকে, বিশেষত কৃষিপণ্যের ক্ষেত্রে যাহাতে মজুতদারির কারণে মূল্যস্ফীতি না ঘটে, সেই দিকেও নজর রাখিতে হইবে। কৃষি আইন বাতিল হওয়ায় অত্যাবশ্যক পণ্য আইনের সংস্কারটিও আপাতত বাতিল হইয়া গেল। অবশ্য, কৃষি আইন থাকিতেও কেন্দ্রীয় সরকার মজুতদারি বন্ধ করিবার উদ্যোগ করিয়াছিল। মোট কথা, অতিমারি-জনিত আর্থিক ধাক্কা হইতে ভারতীয় অর্থব্যবস্থা যখন ঘুরিয়া দাঁড়াইতে চেষ্টা করিতেছে, তখন যেন মূল্যস্ফীতির সমস্যা ফের তাহাকে বিধ্বস্ত না করে, তাহা নিশ্চিত করিবার দায়িত্বটি কেন্দ্রীয় সরকারকেই লইতে হইবে। এই কাজে গাফিলতি চলিতে পারে না।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy