Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪
Rabindranath Tagore

পূজার ছলে

বাঙালির দুর্গাপূজা নানা রূপ ও রূপান্তরের মধ্য দিয়া কেবল ধর্মের বিষয় না থাকিয়া তাহার সমাজ-সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হইয়াছে।

শেষ আপডেট: ১০ অক্টোবর ২০২১ ০৬:১৯
Share: Save:

দুর্গাপূজার সমারোহ লইয়া ঊনবিংশ শতাব্দীতেই নানা কথা উঠিয়াছিল। শহর কলিকাতার হুজুগেপনা ইত্যাদি। হুতোম তাঁহার নকশায় ‘কলিকাতার বারোইয়ারি পূজা’র রংদার বিবরণ প্রদান করেন। সেখানে কেবল পূজা হইত না, আমোদ-আহ্লাদের নানা আয়োজন থাকিত। ‘দুর্গোৎসবের পার্ব্বণী’ বাবুরা নগদে ও উৎসবে প্রদান করিতেন। শুধু যে কলিকাতায় বারোয়ারিতলা জমিয়া উঠিত তাহা নহে, কলিকাতার বাহিরেও কলিকাতার দেখাদেখি নানা নির্মাণ দৃষ্টিগোচর হইত। হুতোম উবাচ: চুঁচড়োর মত বারোইয়ারি পুজো আর কোথাও হইত না। ‘আচাভো’ ‘বোম্বাচাক’ প্রভৃতি সং প্রস্তুত হইত। ‘সহরের ও নানা স্থানের বাবুরা’ ‘বোট’, ‘বজরা’, ‘পিনেস’ ভাড়া করিয়া সং দেখিতে যাইতেন। গুপ্তিপাড়া, কাচড়াপাড়া, শান্তিপুর, উলো— কলিকাতার নিকটবর্তী এইসকল জায়গাতেও বিশেষ আমোদ জমিত। শান্তিপুরওয়ালারা পাঁচলক্ষ টাকা খরচ করিয়া এক বারোইয়ারি পূজা করেন। সাত বৎসর ধরিয়া সে পূজার উদ্যোগ গ্রহণ করা হইয়াছিল। ষাট হাত উঁচু প্রতিমা, বিসর্জনের দিন ‘পুতুল’ কাটিয়া কাটিয়া জলে নিরঞ্জন করিতে হইল। তাহাতে গুপ্তিপাড়াওয়ালারা মাতার আপঘাত মৃত্যু উপলক্ষে গণেশের গলায় কাছা বাঁধিয়া পূজা বসাইয়াছিলেন— তাহাতেও বিস্তর খরচ হইল। খরচের উত্তর খরচ। হুজুগের উত্তর হুজুগ। এ বলিতেছে আমায় দেখ, ও বলিতেছে আমিই বা কম কী! কলিকাতায় পূজা ঘিরিয়া বাবুতে বাবুতে ঠোকাঠুকি, মোসাহেবদের পারস্পরিক তরজার শেষ নাই। শরৎকালের শহর যেন উল্লাসে টগবগ করিয়া ফুটিতেছে। এক বাবু উঠিতেছেন আর এক বাবু পড়িতেছেন। হুতোমের কণ্ঠস্বর দার্শনিকতায় ভরিয়া উঠে, “সময় কারুই হাত ধরা নয়— নদীর স্রোতের মত— বেশ্যার যৌবনের মত ও জীবের পরমায়ুর মত কারুরই অপেক্ষা করে না!”

এই পূজার সমারোহ লইয়া আপত্তি উঠিল। আপত্তি তুলিলেন সেই নব্য শিক্ষিতরা যাঁহারা একেশ্বরবাদী, মূর্তিপূজা-বিরোধী, ব্রহ্মের উপাসক। মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ তাঁহার আত্মজীবনীতে লিখিয়াছিলেন এক সময় তিনি রামমোহনকে দুর্গাপূজার উৎসবে নিমন্ত্রণ করিতে যাইতেন। “রামমণি ঠাকুরের নিবেদন, তিন দিন আপনার প্রতিমা দর্শনের নিমন্ত্রণ।” রামমোহন কেন তাহা গ্রহণ করেন নাই, পরিণত দেবেন্দ্রনাথ তাহা অনুধাবন করিতে পারিয়াছিলেন। “যখনই আমি বুঝিলাম যে ঈশ্বরের শরীর নাই, তাঁহার প্রতিমা নাই, তখন হইতে আমার পৌত্তলিকতার উপর ভারি বিদ্বেষ জন্মিল। ...আমার ভাইদের লইয়া দল বাঁধিলাম। আমরা সকলে মিলিয়া সংকল্প করিলাম যে, পূজার সময়ে আমরা পূজার দালানে কেহই যাইব না, যদি কেহ যাই, তবে প্রতিমাকে প্রণাম করিব না।” আপত্তি কেবল দার্শনিকতার মধ্যে আবদ্ধ রহিল না। পূজা পালন পদ্ধতির মধ্যে যে সমারোহের ও অপব্যয়ের বাহুল্য রহিয়াছে তাহার বিরুদ্ধেও দেবেন্দ্রনাথ সরব হইয়াছিলেন। তত্ত্ববোধিনী পত্রিকায় দুর্গাপূজার সমারোহের বিরুদ্ধে লেখা প্রকাশিত হইল। ব্রাহ্মধর্মাবলম্বীরা অবশ্য তাঁহাদের শীলিত বৌদ্ধিক ধর্মের আন্দোলনে জনসাধারণকে বিপুল পরিমাণে আকর্ষণ করিতে পারেন নাই, তবে তাঁহাদের এই প্রশ্নশীলতা দেবী দুর্গার অপর এক রূপ নির্মাণ করিয়াছিল। তাহা বারোয়ারি হুজুগ নহে, বৌদ্ধিক ও দার্শনিক। বঙ্কিমচন্দ্র তাঁহার ‘কমলাকান্তের দপ্তর’ রচনায় দেবী দুর্গাকে বঙ্গজননী রূপে কল্পনা করিলেন। পৌত্তলিকতার হুজুগ মুছিল, অপব্যয় বন্ধ হইল— দেবী দেশজননী হইলেন। বঙ্কিমের কমলাকান্ত কাঁদিল— বঙ্গজননীর নিরঞ্জন হইয়াছে, মা ডুবিয়াছেন, তাঁহাকে কি উদ্ধার করিবার কেহ নাহি! বাঙালি কি জাগিয়া উঠিয়া দেশমাতৃকাকে উদ্ধার করিবে না!

দেবী দুর্গাকে ঘিরিয়া নানা ভাবের উত্থানপতন একালেও প্রতীয়মান। অতিমারি পূর্বকালে সমারোহের সহিত শিষ্টাচার ও পরিশীলনের সংযোগ কী ভাবে ঘটানো যায়, তাহা লইয়া নানা আয়োজন। থিমপূজা: সমারোহ আর শিল্পকলা মিলাইয়াছিল। উৎসবকে ঘিরিয়া অর্থনৈতিক উদ্যোগ এক দিক হইতে উত্তম— গ্রামীণ শিল্পীরা, শহরের বিপণি মালিকরা লাভবান হন। বহু মানুষ উপার্জনের উপায় খুঁজিয়া পান। পৌত্তলিকতার প্রশ্নটিরও এক রকম সমাধান হইয়াছে— ভক্তের কল্পনা ও মনোবাসনার জগৎ অস্বীকার করিবার উপায় নাই। ভক্ত মৃন্ময়ীর মধ্যে চিন্ময়ীকে কল্পনা করেন। বাঙালির দুর্গাপূজা নানা রূপ ও রূপান্তরের মধ্য দিয়া কেবল ধর্মের বিষয় না থাকিয়া তাহার সমাজ-সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হইয়াছে।

যৎকিঞ্চিৎ

সে তো মন্বন্তরে মরেনি, মারি নিয়েও ঘর করেছে। এখন মারির আগে ‘অতি’ বসেছে তো কী, বাঙালিও অতি ওস্তাদ। কোভিড বাড়ছে? ছোঃ, তা বলে গড়িয়াহাট-হাতিবাগানে গাঁতিয়ে পুজো বাজার করব না? এ বারেও পুজোর ক’দিন মণ্ডপে ‘নো এন্ট্রি’ তো কী, মহালয়া থেকেই মাস্কহীন চষে ফেলব গোটা শহর। ইতিহাসবই থেকে সে আইন অমান্য, অসহযোগ শব্দগুলো ঝাড়া মুখস্থ করেছে, শুধু বেজায়গায় প্রয়োগ করতে গিয়ে এখন গোল্লা পাওয়ার মুখে। ফেল করলে বলবে, ‘সব সিস্টেমের দোষ!’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE