Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪
Domestic Violence

হিংসার সংসার

কেবল পরিবারে নহে, স্বামীর প্রহার রাষ্ট্রেও মেয়েদের স্থান নির্দিষ্ট করিয়া দেয়। সেই স্থান দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিকের।

প্রতীকী ছবি।

প্রতীকী ছবি।

শেষ আপডেট: ০২ ডিসেম্বর ২০২১ ০৬:২২
Share: Save:

অপরের তুলনায় নিজেকে হীন বলিয়া মনে না করিলে, বঞ্চনা ও অমর্যাদাকে আপন প্রাপ্য বলিয়া বিশ্বাস করিতে না পারিলে বশ্যতা ‘স্বাভাবিক’ হইয়া উঠিতে পারে না। একবিংশ শতকের দুই দশক পার করিয়াও ভারতের বহু মেয়ে জীবনসঙ্গীকে ‘প্রভু’ বলিয়া দেখিতেছে, এবং তাঁহার তিরস্কার ও প্রহারকে নিজের প্রাপ্য বলিয়া গণ্য করিতেছে। অর্থাৎ তাহাদের দৃষ্টিতে গার্হস্থ হিংসা ‘অপরাধ’ নহে, তাহা দাম্পত্যে স্বাভাবিক। সাম্প্রতিক জাতীয় পরিবার সমীক্ষা দেখাইয়াছে, তেলঙ্গনা ও অন্ধ্রপ্রদেশের ৮০ শতাংশেরও অধিক মহিলা স্বামীর প্রহারে আপত্তিকর কিছু দেখেন নাই। পশ্চিমবঙ্গে মেয়েদের মধ্যে এই সমর্থন কিছু কম— ৪২%। কিন্তু রামমোহন-বিদ্যাসাগর-রোকেয়ার জন্মভূমিতে তাহা কতটুকু সান্ত্বনা? আজও মহিলাদের ধারণা, রন্ধনে ত্রুটি, গৃহকার্যে অবহেলা, শ্বশুরবাড়ির সদস্যদের প্রতি অসম্মান প্রদর্শন করিলে স্বামী প্রহার করিতেই পারেন। পুরুষদেরও একটি বড় অংশ বলিয়াছেন, স্ত্রীকে প্রহার অপরাধ নহে। এমন মনোভাব হইতেই প্রতি বৎসর গার্হস্থ হিংসায় কয়েক সহস্র বধূর মৃত্যু ঘটিতেছে। ভারতে আজও দাম্পত্য সমানাধিকার, সমান মর্যাদার সম্পর্ক নহে। ভারতীয় সংবিধানে সকল নাগরিকের সমতার আদর্শ, আইনে নারীর সুরক্ষা ও মর্যাদার আশ্বাস, সকলই বৃথা হইয়া যায়, কারণ ভারতের অভ্যন্তরে আজও এক উপনিবেশ রহিয়াছে। সেখানে শাসক পুরুষ, এবং শাসিত নারী। লিঙ্গ-পরিচিতির ভিত্তিতে আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করিয়া মেয়েদের সম্পদ ও শ্রম বিনাশর্তে আত্মসাৎ করিবার ব্যবস্থাটি চালু রাখিতে ঘরে-বাহিরে হিংসার প্রয়োজন হইতেছে।

কেবল পরিবারে নহে, স্বামীর প্রহার রাষ্ট্রেও মেয়েদের স্থান নির্দিষ্ট করিয়া দেয়। সেই স্থান দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিকের। প্রহারের আঘাত মেয়েদের গায়ে কালশিটা ফেলিতেছে, কিন্তু দেশের ভাগ্যের উপরেও কি সেই আঘাতের চিহ্ন পড়ে নাই? কেবল সমাজ নহে, অর্থনীতিতেও তাহার প্রভাব স্পষ্ট। ভারত স্বাধীন হইবার পঁচাত্তর বৎসর পার হইয়াছে, কর্মক্ষেত্রের সকল শাখায় মেয়েরা নিজেদের কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখিয়াছে। দেশে মেয়েদের শিক্ষার হার বাড়িয়াছে, সন্তানের জন্মহার কমিয়াছে, নব্বইয়ের দশক হইতে দেশের অর্থনৈতিক বৃদ্ধির হারও ঊর্ধ্বমুখী হইয়াছে। অন্যান্য দেশে এই সকল শুভ পরিবর্তনের সহিত অধিক সংখ্যায় মেয়েরা যোগদান করিয়াছে কর্মক্ষেত্রে। কিন্তু ভারতে ২০০৫ সাল হইতে মেয়েদের কর্মনিযুক্তি কমিয়াছে। যদি পুরুষ ও নারী সমান হারে শ্রমের বাজারে যোগদান করিতে পারিত, তাহা হইলে জাতীয় উৎপাদন অনেক বাড়িত, এমনই হিসাব করিতেছেন অর্থশাস্ত্রীরা।

বিশেষজ্ঞদের মতে, মেয়েদের নিয়োগের হার কমিবার কারণ, তাহাদের উপরে গৃহকর্ম ও পরিচর্যার দায় প্রায় সম্পূর্ণই চাপাইতেছে পুরুষতান্ত্রিক পরিবার। কর্মরত মহিলাদেরও নিষ্কৃতি নাই। মেয়েদের মর্যাদা ও স্বাতন্ত্র্য প্রতিনিয়ত নানা ভাবে খর্ব হইতেছে, হিংসা তাহার একটি উপায়। অবশ্য গত কয়েকটি সমীক্ষার ফল হইতে ইঙ্গিত মিলিয়াছে যে, পারিবারিক নির্যাতনের প্রতি মেয়েদের সহনশীলতা ক্রমে কমিতেছে। কিন্তু ইহা যথেষ্ট নহে। গৃহ, পথ-পরিবহণ, কর্মক্ষেত্র, সর্বত্র নারীহিংসার যে নিরবচ্ছিন্ন ধারা বহিতেছে, তাহার প্রতি যথেষ্ট অসহিষ্ণুতা এখনও দেখা দেয় নাই।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Domestic Violence
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE