E-Paper

ভাঙা পথ

সংবাদ-আলেখ্যে নানা জেলা থেকে উঠে-আসা এই ঘটনাগুলি কি ব্যতিক্রম?

শেষ আপডেট: ০৯ ডিসেম্বর ২০২৫ ০৮:৪৯
—প্রতিনিধিত্বমূলক ছবি।

—প্রতিনিধিত্বমূলক ছবি।

পশ্চিমবঙ্গের গ্রামীণ রাস্তার যে ছবি পাওয়া যায় সরকারি নথিপত্রে, আর নানা জেলার প্রান্তিক এলাকাগুলিতে গেলে যে ছবি দেখা যাচ্ছে, তার মধ্যে পার্থক্য বিস্তর। সরকারি তথ্য বলছে, প্রধানমন্ত্রী গ্রামীণ সড়ক যোজনায় তৈরি রাস্তা রক্ষণাবেক্ষণের জন্য বিপুল খরচ করে রাজ্য। ২০২২-২৩ সালে খরচ করেছিল একশো কোটি টাকারও বেশি, যা সারা দেশে সর্বাধিক। কেন্দ্র ওই প্রকল্পের বরাদ্দে কার্পণ্য শুরু করলে রাজ্য শুরু করে ‘পথশ্রী’ প্রকল্প। ২০২০ সালে চালু হওয়ার পর তার খরচ ছাড়িয়ে গিয়েছে উনিশ হাজার কোটি টাকা। চলতি অর্থবর্ষের বাজেটে বরাদ্দ হয়েছে দেড় হাজার কোটি টাকা। তা নিয়ে প্রচারও চলছে জবরদস্ত। কিন্তু জেলা শহর-সংলগ্ন এলাকা থেকে চর এলাকা, সর্বত্র রাস্তা বেহাল। দীর্ঘ দিন আবেদন-নিবেদন করে ভুক্তভোগীরা পাচ্ছেন কেবল অসার আশ্বাস। ‘আলোচনা চলছে’ কিংবা ‘টেন্ডার ডাকা হয়েছে’— এই ধরনের প্রতিশ্রুতি নিষ্ঠুর কৌতুক বলে মনে হতে পারে সেরুয়া গ্রামের সেই দুধ বিক্রেতার কাছে, সাড়ে আট কিলোমিটার ভাঙাচোরা রাস্তায় প্রায়ই উল্টে যায় যাঁর সাইকেল, সত্তর লিটার দুধ নষ্ট হয় রাস্তায়। পূর্ব বর্ধমানের ভাতারের কানপুর মোড় থেকে সেরুয়া, নৃসিংহপুর হয়ে সাহেবগঞ্জ মোড় পর্যন্ত এই পিচের রাস্তা ২০১৭ সালে তৈরি হওয়ার পর আর সারাই হয়নি। রাস্তার দুর্দশার জন্য মুর্শিদাবাদের ভগবানগোলার টিকলি চর, নির্মল চর কার্যত বিচ্ছিন্ন। বিপজ্জনক রাস্তায় অভিভাবকরাই স্কুলে পাঠাতে চান না ছেলেমেয়েদের, তাই ঘরে ঘরে স্কুলছুট শিশু। আবার, পশ্চিম মেদিনীপুরের ডেবরায় অত্যাধুনিক সুপারস্পেশ্যালিটি হাসপাতাল যেতে হলে রোগীকে অনেকটা রাস্তা পেরোতে হয় খাটিয়া-বাহকদের কাঁধে, এমনই হাল মোহনপুর গ্রামের রাস্তার।

সংবাদ-আলেখ্যে নানা জেলা থেকে উঠে-আসা এই ঘটনাগুলি কি ব্যতিক্রম? তিক্ত সত্য এই যে, সারা বছরই রাজ্যের নানা এলাকা থেকে খবরে আসে রাস্তার দুর্দশা, আর তার জন্য নাগরিকের চরম দুর্ভোগের নানা ছবি। যেমন, এ বছর জুলাই মাসে পূর্ব মেদিনীপুরের অমরপুর (চৌকিশ্বর) গ্রামের এক বধূ হৃদ্‌রোগে আক্রান্ত হন, ছ’কিলোমিটার কাদা-ভরা রাস্তা পেরিয়ে হাসপাতালে যাওয়ার আগেই মৃত্যু হয় তাঁর। ওই মাসেই ফরাক্কায় বেহাল রাস্তার জন্য দুর্ঘটনায় আহত হয় এক শিশুকন্যা। শাসক দলের বিধায়ক আহতের বাড়িতে গেলে ক্ষুব্ধ প্রতিবেশীরা ঘেরাও করেন তাঁকে। জাতীয় বা রাজ্য সড়কগুলির অবস্থাও তথৈবচ। বাঁকুড়া থেকে কলকাতা যাওয়ার প্রধান রাস্তা দু’নম্বর রাজ্য সড়ক। সেখানে কোতুলপুরের গোগড়া থেকে মিলমোড় পর্যন্ত বড় বড় গর্ত তৈরি হওয়ায় কেবলই দুর্ঘটনা ঘটছে, অ্যাম্বুল্যান্স চালানোও কঠিন হয়ে উঠছে। এমন অজস্র উদাহরণ ছড়িয়ে রয়েছে সারা রাজ্যে।

কত রাস্তা ভাল আর কত খারাপ, তার হিসাব কষা অনর্থক— কারণ খাদ্য, পানীয় জল, বিদ্যুৎ বা আবাসের মতোই, রাস্তাও এক মৌলিক পরিকাঠামো, যাতে রয়েছে প্রতিটি মানুষের অধিকার। সংবিধান-প্রদত্ত জীবনের অধিকারের সঙ্গে একান্ত সংযুক্ত ব্যবহারযোগ্য রাস্তা পাওয়ার অধিকার— জঘন্য রাস্তার জন্য চিকিৎসাকেন্দ্রে পৌঁছনোর বিলম্বে কত রোগীর প্রাণ গিয়েছে, সে দিকে তাকালেই তা বোঝা যায়। একই রকম গুরুত্বপূর্ণ জীবিকার প্রশ্নটি। রাস্তা খারাপ হওয়ার জন্য কৃষিপণ্য বইতে বেশি ভাড়া দাবি করছেন টোটো চালক, লরি-চালকেরা। ফসলের দাম কম দিচ্ছেন ব্যবসায়ীরা। শিক্ষা-বিচ্ছিন্ন হয়ে উচ্চ আয়ের সম্ভাবনা হারাচ্ছে শিশুরা। অথচ, খারাপ রাস্তার কারণটি একেবারে প্রত্যক্ষ— দলীয় দুর্নীতি ও ঠিকাদারতন্ত্র। স্থানীয় নেতা-কর্মীদের উৎকোচ-লোলুপতায় রাস্তার কাজ হয় নিম্নমানের, রক্ষণাবেক্ষণের দায়ও সহজে এড়াতে পারে ঠিকাদার। নেতা, আধিকারিকদের ক্ষমতা নেই ঠিকাদারদের থেকে কাজ আদায় করার। হয়তো আগ্রহও নেই। ভগ্ন রাস্তার কারণ আইনশৃঙ্খলার ভগ্নদশা।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Rural Roads Pathasree Project

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy