Advertisement
০৪ মে ২০২৪
Opposition Alliance

অহংবোধ বনাম ঐক্য

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে আলোচনা সেরেই তাঁরা উত্তরপ্রদেশে অখিলেশ যাদবের সঙ্গে দেখা করেন এবং তার পরেই অখিলেশ-মমতা কথোপকথনও ঘটে।

Mamata Banerjee.

মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ফাইল চিত্র।

শেষ আপডেট: ০৩ মে ২০২৩ ০৬:০১
Share: Save:

শাসক বিজেপি তথা নরেন্দ্র মোদীর বিরুদ্ধে সর্বভারতীয় রাজনীতিতে প্রতিস্পর্ধী জোট গড়ে তোলার পথে বাধা অনেক, সে-কথা ইতিমধ্যে বহুচর্চিত। সাম্প্রতিক কালে সেই বাধাগুলি দূর করার কিছু উদ্যোগ দেখা গিয়েছে। সিবিআই বা ইডি-র মতো কেন্দ্রীয় তদন্ত সংস্থাগুলিকে ক্রমাগত রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করার অভিযোগে প্রায় সমস্ত বিরোধী দল সমবেত প্রতিবাদে সরব ও সক্রিয় হয়েছে। কিন্তু জোট বাঁধার পথে এখনও বহু প্রশ্ন, বহুবিধ সংশয়। অথচ স্বাভাবিক নির্ঘণ্ট অনুসারে আগামী লোকসভা নির্বাচনের প্রচারপর্ব শুরু হতে আর এক বছরও বাকি নেই। সুতরাং গণতন্ত্রের ধর্মক্ষেত্রে অবতীর্ণ হওয়ার লক্ষ্যে সংহতির সন্ধান করতে চাইলে দেশের বিরোধী দলনেতা ও নেত্রীদের হাতে নষ্ট করার মতো সময় আর অবশিষ্ট নেই। দৃশ্যত এই বোধ থেকেই বিহারের নীতীশ কুমার ও তেজস্বী যাদব সম্প্রতি নবান্নে সমাগত হয়েছিলেন। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে আলোচনা সেরেই তাঁরা উত্তরপ্রদেশে অখিলেশ যাদবের সঙ্গে দেখা করেন এবং তার পরেই অখিলেশ-মমতা কথোপকথনও ঘটে। বিরোধী জোটের সম্ভাবনাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার প্রচেষ্টায় এই উদ্যোগকে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা বলে মনে করার কারণ আছে। বিজেপির স্থানীয় নেতারা এই তৎপরতাকে তাচ্ছিল্য করতে যে ভাবে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন, যে সব বাক্যবাণ নিক্ষেপ করেছেন, তা বুঝিয়ে দেয়, তাঁরাও এই উদ্যোগের দিকে শ্যেনদৃষ্টিতে নজর রেখেছেন।

এই পরিপ্রেক্ষিতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের একটি মন্তব্য বিশেষ ভাবে তাৎপর্যপূর্ণ। বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ কুমারের সঙ্গে আলোচনার পরে তিনি বিরোধী জোটের গুরুত্ব নিয়ে কথা বলতে গিয়ে জানিয়েছেন, “আমরা এক সঙ্গে চলতে চাইছি, এখানে ব্যক্তিগত অহংয়ের ব্যাপার নেই।” এই উক্তিতে আত্মসমালোচনার সঙ্কেত বা আত্মসংশোধনের আকাঙ্ক্ষা নিহিত আছে কি না, সেই প্রশ্ন অসঙ্গত নয়, কারণ পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর কথায় ও আচরণে অহংবোধের পরিচয় বিরল নয়। বিশেষত, বিরোধী জোটের প্রশ্নে তাঁর ভূমিকা নিয়ে অনেক সময়েই এই সমালোচনা হয়েছে যে, যথেষ্ট গুরুত্ব না পেলে তিনি জোটে যেতে বা থাকতে নারাজ। কিন্তু সেই প্রশ্ন আপাতত গৌণ। গুরুত্ব চান না, বর্তমান ভারতে এমন রাজনীতিক বিরল বললে কম বলা হবে। রাজনীতিকের ব্যক্তিগত চাহিদা বা স্বভাবের থেকে বহুগুণ বেশি গুরুত্বপূর্ণ তাঁর বাস্তববোধ। ভারতীয় রাজনীতির বাস্তব এখন এমনই যে, বিভিন্ন রাজ্য তথা অঞ্চলের বিভিন্ন প্রধান রাজনৈতিক দল তথা তাদের নায়কনায়িকারা নিজস্ব অহংবোধ সরিয়ে রেখে জোট গড়তে না পারলে বিরোধী ঐক্য আদৌ সম্ভব নয়। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উক্তিতে সেই বাস্তবের সুস্পষ্ট স্বীকৃতি আছে।

নেতানেত্রীদের অহংবোধ সরিয়ে রেখে জোট গড়বার নীতি গভীরতর একটি কারণেও গুরুত্বপূর্ণ। নরেন্দ্র মোদী এবং তাঁর দলের সর্বগ্রাসী আধিপত্যে অহংবোধের এক বিরাট ভূমিকা আছে। তার বিপরীতে কার্যকর রাজনৈতিক প্রতিস্পর্ধা যদি নির্মাণ করতে হয়, তবে কেবল আসন বণ্টনের বোঝাপড়াই যথেষ্ট নয়, একটি বিকল্প রাজনীতির ধারণাও অত্যাবশ্যক। সেই ধারণার ভিত্তিতে যেমন একটি ন্যূনতম অভিন্ন কর্মসূচির প্রয়োজন, তেমনই প্রয়োজন একটি মানসিকতা। বিরোধী নেতানেত্রীরাও যদি অহংবোধের দ্বারা চালিত হন, তবে তাঁরা সেই বিকল্প ধারণা সরবরাহ করতে ব্যর্থ হবেন। শাসকের আমিত্বের বিপরীতে যথার্থ প্রতিস্পর্ধা তুলে ধরার জন্য অন্য আমিত্ব খাড়া করলে চলবে না, আমিত্বের ধারণাটিকেই অস্বীকার করতে হবে। বস্তুত, এই ভাবেই শাসকের সংখ্যাগুরুবাদের বিপরীতে একটি সত্যকারের বহুত্ববাদী উদার গণতন্ত্রকে জনসাধারণের সামনে প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব। অহংবোধ বিসর্জন দেওয়া কেবল বিরোধী ঐক্যের জন্য আবশ্যক নয়, তা প্রকৃত গণতন্ত্রের আবশ্যিক শর্ত।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

opposition alliance Mamata Banerjee BJP
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE