E-Paper

দক্ষিণের দরজা

দক্ষিণ ভারতের রাজনীতিতে ধর্ম আছে, ব্রাহ্মণ্যবাদ আছে, জাতপাতের হিসাব আছে— উত্তর ভারতে যা আছে, দক্ষিণেও তা-ই আছে। কিন্তু, এক ভাবে নেই।

শেষ আপডেট: ০৮ জানুয়ারি ২০২৪ ০৮:১০
An Image Of PM Narendra Modi

প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। —ফাইল চিত্র।

নতুন সংসদ ভবনের প্রতীক হিসাবে ‘সেঙ্গল’-কে বেছে নেওয়ার সিদ্ধান্তকে যে প্রধানমন্ত্রী রাজনৈতিক ভাবে ব্যবহার করবেন, তা নিয়ে কারও সংশয় ছিল না। অতএব, তামিলনাড়ুতে তাঁর বক্তৃতা জুড়ে সেঙ্গল-প্রসঙ্গে অবাক হওয়ার কারণ নেই। কিন্তু, কেন তাঁকে দক্ষিণ ভারতের দিকে বিশেষ মনোযোগ দিতে হচ্ছে, এই প্রশ্ন করলেই শোনা যাচ্ছে একটি কথা: বিজেপির রাজনীতি বিন্ধ্য পর্বত টপকে দক্ষিণ ভারতে পৌঁছতে পারে না। গত মে মাসে কর্নাটকে, এবং ডিসেম্বরে তেলঙ্গানায় বিধানসভা নির্বাচনে কংগ্রেসের জয়ই এই বিশ্বাসের উৎস। কংগ্রেসের সমর্থকরা তো বটেই, উদারবাদী ভারতীয়রাও এই বিশ্বাসের খড়কুটো আঁকড়ে ধরে আশায় আছেন, দক্ষিণ ভারতই গড়ে তুলবে বিজেপির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ। তর্কের খাতিরে— যদি তা-ই হয়, তবুও কি বিরোধীরা জিতবেন? দক্ষিণ ভারতের পাঁচ রাজ্যে লোকসভায় মোট আসনসংখ্যা ১২৯। ২০১৯ সালে তার মধ্যে মাত্র ২৯টি আসনে জিতেছিল বিজেপি— কর্নাটকে ২৫টি, তেলঙ্গানায় ৪টি। তাতে বিজেপির লোকসভায় ৩০৩টি আসন অর্জনে অসুবিধা হয়নি। তর্কের খাতিরে যদি ধরে নেওয়া যায়, ২০২৪-এ দক্ষিণ ভারতে বিজেপি একটিও আসন পাবে না, কিন্তু গত দফায় জেতা বাকি আসনগুলি বজায় থাকবে, তা হলেও লোকসভায় বিজেপির আসনসংখ্যা দাঁড়াবে ২৭৪টি— তাতেও একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা বজায় থাকবে। অর্থাৎ, আক্ষরিক অর্থেই দক্ষিণ ভারতের আসন বিজেপির দরকার নেই। কিন্তু, অন্তত তেলঙ্গানার নির্বাচনের ফলাফল দিয়ে বলা যাবে না যে, দাক্ষিণাত্যে বিজেপি ঠেকে যাচ্ছে। সেখানে ভোটে বিজেপির ভোটপ্রাপ্তির হার বেড়েছে বিপুল পরিমাণে, প্রায় সাত শতাংশ; আসনসংখ্যা এক থেকে বেড়ে হয়েছে আট। অর্থাৎ, তেলঙ্গানায় এই প্রথম বিজেপি একটি তাৎপর্যপূর্ণ রাজনৈতিক শক্তি হয়ে উঠছে।

কিন্তু, তার চেয়েও বড় প্রশ্ন হল, দক্ষিণ ভারতের পাঁচটি রাজ্য— যেগুলির মধ্যে রাজনৈতিক ও সামাজিক ব্যবধান যথেষ্ট— বিজেপি বিরোধিতার প্রশ্নে এক রকম ভাবছে কি? তাদের বিজেপি বিরোধিতার মধ্যে একটি সাধারণ সূত্র নিশ্চয়ই, বিজেপি হিন্দি ভাষার সংস্কৃতির প্রতিনিধিত্ব করে। কর্নাটকের নির্বাচনে বিজেপির প্রচারপর্ব খুব বেশি দিল্লি-কেন্দ্রিক হওয়ায় দল ধাক্কা খেয়েছিল। কিন্তু, এক দিল্লির দলকে ত্যাগ করে অন্য দিল্লির দলের ঝুলি ভরে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেবেন কেন ভোটাররা? এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ হল রাজ্যস্তরের রাজনীতি— সর্বভারতীয় দলগুলি কী ভাবে রাজ্যস্তরের রাজনৈতিক প্রশ্ন এবং ভাবাবেগের সঙ্গে নিজেদের সংযুক্ত করতে পারে; স্থানীয় দলগুলিই বা কী ভাবে রাজ্যের দাবি বজায় রাখতে পারে। অর্থাৎ, দক্ষিণ ভারতের ভোটারের চরিত্রগত বিজেপি-বিরোধিতা আছে ধরে নিলে ভুল হবে— বলা যেতে পারে, দক্ষিণ ভারতীয় জাতীয়তার প্রশ্নটিকে কোন দল কতখানি দক্ষ ভাবে সামলাতে পারছে, সেটাই কথা।

দক্ষিণ ভারতের রাজনীতিতে ধর্ম আছে, ব্রাহ্মণ্যবাদ আছে, জাতপাতের হিসাব আছে— উত্তর ভারতে যা আছে, দক্ষিণেও তা-ই আছে। কিন্তু, এক ভাবে নেই। দুই প্রান্তের ইতিহাস আলাদা, সামাজিক বিন্যাসের চরিত্র আলাদা। বিনা আয়াসে দাক্ষিণাত্য বিজয়ের খোয়াবে মশগুল কংগ্রেস ও অন্যান্য উদারবাদী শক্তি বা নাগরিক সমাজ যা খেয়াল করেনি, তা হল, নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বে বিজেপি এই চারিত্রিক পার্থক্যটিকে ধরার চেষ্টা করছে। উত্তরের রাম (মন্দির)-কেন্দ্রিক হিন্দুত্ব নয়, বরং চোল সাম্রাজ্যের সেঙ্গলকে হিন্দু ঐতিহ্যের প্রতীক হিসাবে ব্যবহার করছে— দক্ষিণের প্রতীককে আত্মসাৎ করার চেষ্টা করছে। ‘হিন্দি’ ভাষার প্রতিনিধি দলের তকমাটি ঝেড়ে ফেলতে সক্ষম হলে বাকি খেলা তুলনায় সহজ। উদারবাদী ভারতের দুর্ভাগ্য যে, দাক্ষিণাত্যে সাম্প্রদায়িকতার নতুন ভাষ্য তৈরির এই প্রক্রিয়ার কোনও প্রতিস্পর্ধী অবস্থান বিরোধী রাজনীতি এখনও তৈরি করতে পারেনি।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Lok Sabha Election 2024 PM Narendra Modi Tamil Nadu South India BJP Government BJP

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy