কোভিড অতিমারির মধ্যাহ্নে আন্তর্জাতিক বাজারে এক ব্যারেল অপরিশোধিত তেলের দাম ২০ ডলারেরও নীচে নেমে গিয়েছিল। প্রতীকী ছবি।
ঠিক হয়েছিল, তেলের দামের নিয়ন্ত্রণ ছাড়া হবে বাজারের হাতে। সেই অনুযায়ী ২০১০ সালে পেট্রল, এবং ২০১৪ সালে ডিজ়েলের দামের থেকে সরকারি নিয়ন্ত্রণ তুলে নেওয়া হয়। অর্থাৎ, কম-বেশি গত এক দশক ধরে ভারতের বাজারে পেট্রল-ডিজ়েলের দাম স্থির করার কথা পেট্রো-বিপণন সংস্থাগুলির। আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম যে ভাবে বাড়বে-কমবে, দেশের বাজারেও খুচরো বিক্রয়মূল্যে তার প্রতিফলন ঘটবে। কিন্তু, এই কম-বেশি এক দশক সময়ের প্রায় নব্বই শতাংশ জুড়ে দিল্লির মসনদে বিরাজ করেছে নরেন্দ্র মোদীর সরকার। বাজার প্রক্রিয়ায় এই সরকারের প্রকৃত আস্থা আছে, তেমন কোনও প্রমাণ গত সাড়ে আট বছরে মেলেনি— পেট্রোপণ্যের দামও সেই নিয়মের ব্যতিক্রম নয়। বরং, রাজনীতির যুক্তিতে অর্থব্যবস্থা পরিচালনার নিরন্তর উদাহরণ মিলেছে।
খাতায়-কলমে তেলের দাম নিয়ন্ত্রণমুক্ত, কিন্তু খিড়কির দরজা দিয়ে সেই দামের রাশ সরকার ধরে রেখেছে— এই ব্যবস্থার দু’টি দিক আছে। প্রথমত, দেশের কোনও প্রান্তে নির্বাচনের ঢাক বেজে উঠলেই তেলের দামের ওঠাপড়া বন্ধ হয়ে যায়। পশ্চিমবঙ্গে বিধানসভা নির্বাচনের আগে হয়েছিল, উত্তরপ্রদেশ, পঞ্জাব নির্বাচনের সময়েও হয়েছিল, গুজরাত, হিমাচল প্রদেশের নির্বাচনের সময়ও হল। তেলের দাম রাজনৈতিক ভাবে অতি স্পর্শকাতর বিষয়, সন্দেহ নেই— তার ওঠাপড়ার আঁচ সটান ভোটারের পকেটে পড়ে। ফলে, ভোট এলেই তেলের দাম বেঁধে দেওয়ার রাজনৈতিক প্রবণতার অর্থ বোঝা কঠিন নয়। কিন্তু, তার ফলে তেল সংস্থাগুলির তহবিলে কতখানি চাপ পড়ে, সরকার আদৌ তার হিসাব কষে কি না, বা প্রশ্নটিকে গুরুত্ব দেয় কি না, সে কথা বোঝা দুষ্কর। সাম্প্রতিক পরিসংখ্যান বলছে, ২০২২ সালের এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বর, এই ছ’মাসে তেল সংস্থাগুলির মোট যত লোকসান হয়েছে, তত লোকসান এ যাবৎ কোনও ছ’মাসের সময়কালে হয়নি। তাও, সরকার ২২,০০০ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ বাবদ দিয়েছিল, ফলে লোকসানের অঙ্কটি কম দেখাচ্ছে। নিয়ন্ত্রণের দ্বিতীয় দিক হল, আন্তর্জাতিক বাজারে যখন তেলের দামে পতন ঘটে, তখন দেশের বাজারে তেলের উপর বাড়তি শুল্ক আরোপ করে রাজকোষ ভরা, ক্রেতাদের কাছে সেই পড়তি দামের সুবিধা পৌঁছতে না দেওয়া। কোভিড অতিমারির মধ্যাহ্নে আন্তর্জাতিক বাজারে এক ব্যারেল অপরিশোধিত তেলের দাম যখন ২০ ডলারেরও নীচে নেমে গিয়েছিল, ভারতের বাজারে তার বিন্দুমাত্র সুফল পৌঁছয়নি, কারণ সরকার শুল্কের পরিমাণ বৃদ্ধি করে অন্যান্য কর আদায়ের ব্যর্থতা ঢাকতে ব্যস্ত ছিল। এখনও একই ঘটনা ঘটছে— আন্তর্জাতিক বাজারে ব্যারেলপ্রতি তেলের দাম ১১৬ ডলার থেকে কমে ৮৩ ডলারে এসেছে, কিন্তু পেট্রল পাম্পগুলিতে দামের কাঁটা অবিচলিত।
বাজারপ্রক্রিয়াকে ব্যাহত করার এই প্রবণতার দু’টি দিক আছে। প্রথমত, তা তেল বিপণন সংস্থাগুলির আর্থিক স্বাস্থ্যের পক্ষে মারাত্মক— বাজারের চলন অনুসারে মুনাফা করার অধিকার যে কোনও স্বশাসিত সংস্থার মৌলিক দাবি। খিড়কির দরজা দিয়ে সরকারি নিয়ন্ত্রণ এই সংস্থাগুলিকে সমানেই অকুশলী করে তুলছে। অন্য দিকে, ক্রেতারও ক্ষতি। নির্বাচনী মরসুম বাদে অন্য কোনও সময়ে আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম চড়লে তার বোঝা তৎক্ষণাৎ ক্রেতার ঘাড়ে চাপে, কিন্তু সেই বাজারে দাম কমলে তার কোনও সুফল তাঁদের কাছে পৌঁছয় না— এমন নীতি ক্রেতাস্বার্থ রক্ষা করে না। বাজারপ্রক্রিয়ায় হস্তক্ষেপ করার এই বিপদ— তা যেতে কাটে, আসতেও কাটে। কতিপয় সাঙাতের কাছে দেশের ভান্ডার উন্মুক্ত করে দেওয়াকে যে বাজারব্যবস্থা বলে না, তা ভিন্ন সাধনার ফল, এই কথাটি নরেন্দ্র মোদীর সরকার স্বীকার করতে নারাজ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy