E-Paper

পৌষের ডাক

লক্ষণীয়, বাঙালির এই মনোভূমিতে পিঠে-র জায়গাটি এখনও প্রবল। সংস্কৃতি আসে-যায়, রূপ বদলায়, পিঠে-পার্বণ থেকে পার্বণটি ঝরে গেলেও পিঠে থেকে যায়।

শেষ আপডেট: ১৩ জানুয়ারি ২০২৪ ০৮:০১
Poush Parbon

—ফাইল চিত্র।

একটি প্রশ্ন অতিজিজ্ঞাসিত, এখনও উত্তর মেলেনি। সংস্কৃতি কি অপরিবর্তনীয়? না কি অপরিবর্তনীয় বলে যাকে মনে হয়, তাও আসলে পরিবর্তনশীলতারই ভিন্ন রূপ? পৌষের সংক্রান্তিতে যখন প্রবাসী বাঙালি বছরকার ছুটি কাটিয়ে আবার নিজ নিজ বিদেশবাসভূমিতে প্রত্যাগমনরত, এ দিকে মন তখনও লগ্ন পিঠে-পার্বণের স্বদেশে, প্রশ্নটি আবার নতুন করে জাগে। কেননা, এই সেই জনস্থান-মধ্যবর্তী বাঙালি মনোভূমি, যেখানে কোজাগরী লক্ষ্মী হইহই করে জেতেন, তা দেখে পৌষলক্ষ্মী মুচকি হাসেন। দুর্গাপুজো শেষ হলেই মহাসমারোহে কোজাগরী পুজো এলে সংবাদমাধ্যম থেকে হাটে-বাজারে, শপিং মলে সর্বত্র তাঁর জয়জয়কার হয়। প্যাঁচাবাহনা দেবীর হরেক আকারের মূর্তি বাজারে বিকোয়, কোন তারকা-নারী লক্ষ্মীর আবাহন করছেন সেই ছবি সংবাদমাধ্যমে সমাজমাধ্যমে আছড়ে পড়ে। ও দিকে সংবাদমাধ্যমে যাঁর কোনও আধিপত্য নেই, সেই পৌষলক্ষ্মী বিজ্ঞাপনের আড়ালে থাকেন নিঃশব্দে, আপনিই, থেকে যান ভাষায়, সংস্কৃতিতে। আগামী সোমবার মকর সংক্রান্তি। বাঙালি আজকাল যদিও দিনটির তাৎপর্য বলতে বোঝে কেবল সাগরস্নান, তবে এ দিনই কেঁদুলির অজয় নদের কদম্বখণ্ডীর ঘাটে গঙ্গাস্নানের গরিমা, পুরুলিয়ায় টুসু পরব, সুবর্ণরেখা নদীতেও স্নান।

লক্ষণীয়, বাঙালির এই মনোভূমিতে পিঠে-র জায়গাটি এখনও প্রবল। সংস্কৃতি আসে-যায়, রূপ বদলায়, পিঠে-পার্বণ থেকে পার্বণটি ঝরে গেলেও পিঠে থেকে যায়। আগেকার দিনে সংক্রান্তির ভোর থেকেই খেজুরের রস জ্বাল দিয়ে গুড় তৈরি হত। দীনেন্দ্রকুমার রায় লিখেছিলেন, দুপুরের সময় প্রায় কোনও বাড়িতেই ভাতের আয়োজন হত না। দিনের বেলায় সিদ্ধ পুলি, রাতে গোকুল পিঠে, সরুচাকলি। বাংলার গ্রামের উঠোনে অল্প চালগুঁড়ো ছড়িয়ে গান হত, ‘এসো পৌষ, যেয়ো না/ভাতের হাঁড়িতে থাকো পৌষ, যেয়ো না/পৌষ মাস লক্ষ্মী মাস, যেয়ো না।’ ‘পৌষ আগলানো’র সেই সময়ে সম্বৎসরের নতুন চাল উঠত, কৃষিনির্ভর দেশে সবচেয়ে সুখের মাস বলে তা গণ্য হত। এখন বিশ্ব উষ্ণায়নের জেরে শীতের কামড় গিয়েছে, চালের সময় পাল্টেছে, পৌষের গুরুত্বও হ্রাস পেয়েছে। আধুনিক বাঙালি শিশু ইউটিউব-এ ঠাকুরমার ঝুলি শুনে জানে কাঞ্চনমালা আর কাঁকনমালার গল্প। রাজা চোখে দেখেন না, দাসী কাঁকনমালা রানির বেশ ধরেছেন, রানি পর্যবসিত হয়েছেন দাসীতে। গোল বাধল উৎসবের দিন, সে দিন রানি বানালেন আস্কে পিঠে, চাস্কে পিঠে, আর দাসী বানাল চন্দ্রপুলি, ক্ষীরমুরলী। পিঠেই ধরে দিল, কে আসল রানি, আর কে দাসী! এই ভাবেই পিঠের কাহিনির মধ্যে পড়ে সমাজ আর তার নানা বিভাজনের ছায়া।

আধুনিক গৃহকোণে আজ আর সারা দিন হরেক রকম পিঠে বানানোর ফুরসত নেই। মনোরঞ্জন পিঠে, চিঁড়ে ও চালে তৈরি পানপিঠে, পাকনপিঠে, টিপপিঠে, দুধপুলি, এত শত জানা বা ভাবার আয়োজন নেই। তবু থেকে গিয়েছে পিঠের প্রতি টান। পিঠে বানিয়ে না হলেও আনিয়ে খাওয়ার চল। পৌষ এসে জানান দেয়, দিন বদলালেও বদলায় না পিঠেপুলি উৎসব, সে নাহয় পাড়ায় পাড়ায় তার কদর রাজনৈতিক অনুপ্রেরণাতেই হোক। সরব পুজোপার্বণের পাশে পিঠেপার্বণ নীরবে টিকে থাকে। পৌষলক্ষ্মী মুচকি হাসেন। আদুরে সেই লক্ষ্মীকে ঘিরে থেকে যায় প্রিয় প্রবাদ— কারও পৌষ মাস, কারও সর্বনাশ।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Poush Parbon Bengali Culture laxmi puja

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy