Advertisement
০৫ মে ২০২৪
NMC Logo

চিকিৎসা নামক ধর্ম

বিতর্কের কারণ লোগোটির হিন্দুত্ববাদী চরিত্র, যা এ দেশের সংবিধানবর্ণিত বৈশিষ্ট্যগুলির সঙ্গে মোটেই মানানসই নয়। আপত্তিও উঠেছে সেই মর্মেই।

এনএমসি-র লোগো নিয়ে বিতর্ক। —ফাইল চিত্র।

এনএমসি-র লোগো নিয়ে বিতর্ক। —ফাইল চিত্র।

শেষ আপডেট: ১৬ ডিসেম্বর ২০২৩ ০৮:১২
Share: Save:

জনস্বাস্থ্য, প্রত্যন্ত অঞ্চলে পরিকাঠামোকে মজবুত করা এবং চিকিৎসক-রোগীর পারস্পরিক সংযোগ বৃদ্ধি— ভারতের মতো দেশে চিকিৎসাব্যবস্থার ক্ষেত্রে এই বিষয়গুলিই প্রশাসনিক স্তরের মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত ছিল। কিন্তু সম্প্রতি সেই লক্ষ্যের বাইরে ঝোপঝাড় পেটানোর বাদ্যিই যেন অধিক শোনা যাচ্ছে। সম্প্রতি ন্যাশনাল মেডিক্যাল কমিশন-এর লোগো পরিবর্তন ঘিরেও তেমন আবহ ফের রচিত হল। এনএমসি-র নতুন লোগোটিতে হিন্দু চিকিৎসাশাস্ত্রের দেবতা ধন্বন্তরির রঙিন প্রতিচ্ছবি গৃহীত হয়েছে। দীর্ঘ দিন ধরে চলে আসা লোগো পরিবর্তন কোনও অপ্রত্যাশিত ঘটনা নয়। যা অপ্রত্যাশিত তা হল, লোগো পরিবর্তনকে ঘিরে সর্বভারতীয় প্রেক্ষাপটে ধর্মীয় মেরুকরণের বিষয়টিকে আরও এক বার খুঁচিয়ে তোলা। প্রসঙ্গত, পূর্বতন মেডিক্যাল কাউন্সিল অব ইন্ডিয়া, যার পরিবর্তে ২০২০ সালে এনএমসি-র প্রতিষ্ঠা, তার লোগোতে গ্রিক ধর্মীয় প্রতিকৃতি ব্যবহৃত হয়ে এসেছিল কয়েক দশক ধরে। কিন্তু সেই প্রতিকৃতির ভিতর এক ধরনের বৈশ্বিক আধুনিক বিজ্ঞানসম্মত চিকিৎসাব্যবস্থার স্পর্শ ছিল, এক উদার, ধর্মনিরপেক্ষ দেশের সঙ্গে যা সামঞ্জস্যপূর্ণ। অতঃপর গত বছরের শেষার্ধে এনএমসি-র হাত ধরে সাদা-কালোয় ধন্বন্তরির আগমন, যা সম্প্রতি রঙিন স্পষ্টতর হয়ে প্রত্যাশিত ভাবেই বিতর্ক উস্কে দিয়েছে।

বিতর্কের কারণ লোগোটির হিন্দুত্ববাদী চরিত্র, যা এ দেশের সংবিধানবর্ণিত বৈশিষ্ট্যগুলির সঙ্গে মোটেই মানানসই নয়। আপত্তিও উঠেছে সেই মর্মেই। এক ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক দেশে যে কোনও সরকারি প্রতিষ্ঠানের লোগোতে ধর্ম-বর্ণ-লিঙ্গ নির্বিশেষে সমস্ত নাগরিকের আশা-আকাঙ্ক্ষা সমান গুরুত্ব সহকারে প্রতিফলিত হওয়া উচিত। কিন্তু এনএমসি-র লোগোয় ধন্বন্তরির প্রতিকৃতি সেই প্রত্যাশানুরূপ নয়। অবশ্য এই প্রথম নয়। ইতিপূর্বে ডাক্তারি পড়ুয়াদের ‘পরিবর্তিত চরক শপথ’ পাঠ করার, আন্তর্জাতিক যোগ দিবসের আগে ১০ দিন যোগাসন অনুশীলনের পরামর্শ দিয়ে বিতর্কে জড়িয়েছে এনএমসি। সেই কারণেই একে নিছক লোগো পরিবর্তনের উদ্যোগ ভাবলে ভুল হবে। বরং ভারতের প্রাচীনত্ব এবং ঐতিহ্যের নামে শিক্ষা, স্বাস্থ্য-সহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে গৈরিকীকরণের যে উদ্যোগ, লোগো পরিবর্তনকেও সেই আঙ্গিকেই বিচার করা প্রয়োজন।

বিতর্ক চিকিৎসকের দায়িত্ব নিয়েও। রোগীকে আরোগ্যের পথে নিয়ে যাওয়া এক জন চিকিৎসকের প্রধান ধর্ম। চিকিৎসক এবং রোগীর পারস্পরিক সম্পর্কের ভিত্তিটি রচিত হয় আস্থা এবং বিশ্বাসের উপর ভিত্তি করে। ধর্ম, জাতপাত, লিঙ্গের মতো সঙ্কীর্ণ বিষয়গুলি এই সম্পর্কের মধ্যে স্থান পাবে না— এমনটাই ধ্রুব সত্য। সেই সত্যের সামান্য বিচ্যুতিও চিকিৎসকের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলতে পারে। একই ভাবে এক সর্বভারতীয় চিকিৎসা সংক্রান্ত সরকারি সংগঠনের হিন্দুত্বের প্রতি প্রচ্ছন্ন প্রশ্রয় চিকিৎসকের প্রতি সাধারণ নাগরিকের বিশ্বাসের জায়গাটিকে টলিয়ে দিতে পারে। আইএমএ তাদের আপত্তি প্রসঙ্গে এই বিষয়টিতেও জোর দিয়েছে। স্বাস্থ্যের মতো অতি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে গেরুয়ার পোঁচ লাগানোর আগে সরকার যে ‘চিকিৎসক’ ভূমিকাটির ধর্ম ও তাঁর মৌলিক কর্তব্যগুলি এক বার পাঠের প্রয়োজনটুকু বোধ করল না, সেটাই ঘোর দুর্ভাগ্য।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Society Medical Science
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE