অচ্ছে দিন বা অমৃতকাল নিয়ে তৃণমূল নেতা-মন্ত্রীদের কটাক্ষের শেষ নেই। সে সবের পালা শেষ হলে তাঁরা যদি এক বার ভুল করেও আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়াতেন, তবে দেখতে পেতেন তৃণমূল জমানায় পশ্চিমবঙ্গের দিনকাল কোথায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে। ২০২৪ সালে কলকাতার উপকণ্ঠে সোনারপুরে বসছে সালিশি সভা, এলাকার তৃণমূল-ঘনিষ্ঠ জমি-ব্যবসায়ী জামাল সর্দারের প্রাসাদোপম বাড়িতে এক স্থানীয় মহিলাকে বেধড়ক মারধর করা হচ্ছে শিকলে বেঁধে, বাঁশ দিয়ে পিটিয়ে! সালিশি সভার ঘরে পাথর বসানো মেঝেতে শিকল বাঁধার আংটা, ঘরে সব সময় মজুত বাঁশ, শিকল— ইতিহাসের সরল তুলনায় যাকে ‘মধ্যযুগীয়’ বলা হয়, ঠিক সেই দৃশ্যই দেখা যাচ্ছে ২০২৪-এর পশ্চিমবঙ্গে। এখন হইচই আর থানা-পুলিশের পরে জানা যাচ্ছে এ কোনও বিক্ষিপ্ত বা নতুন ঘটনা নয়: এমন সালিশি সভা সেই বাড়িতে বসেছে আগেও, স্থানীয় মহিলারা নিগৃহীতা হয়েছেন আগেও!
আর কোনও রাজ্যে, অন্য কোনও রাজনৈতিক দলের রাজত্বে কি এ-হেন জামাল সর্দারদের দেখা পাওয়া যাবে না? নিশ্চয়ই যাবে। তা হলে শুধু তৃণমূল আমলের পশ্চিমবঙ্গকেই কাঠগড়ায় তোলা কেন? তার কারণ, সাম্প্রতিক কালের পশ্চিমবঙ্গে এদের উপস্থিতি এবং কুকীর্তি মাত্রা ছাড়াচ্ছে বলে। কারণ, উত্তরপ্রদেশ হরিয়ানা রাজস্থান বা কর্নাটক থেকে প্রায়ই সালিশি সভার নামে যে চরম হিংস্র, পুরুষতান্ত্রিক, মানবাধিকার-পরিপন্থী ‘খাপ’ শাসনের উদাহরণগুলি খবরবাহিত হয়ে এসে আমাদের প্রথমে আতঙ্কিত করলেও পরমুহূূর্তে আশ্বস্ত করত এ ভাবিয়ে যে, অন্তত পশ্চিমবঙ্গে কোনও নাগরিকের সঙ্গে এ রকম অমানুষিক আচরণ ঘটবে না— সেই আশ্বাসটি পশ্চিমবঙ্গে পাটে যেতে বসেছে। কারণ, এই মুহূর্তে ভারতের একমাত্র মহিলা মুখ্যমন্ত্রী-শাসিত রাজ্যেও যখন মহিলাদেরই পারিবারিক বা সামাজিক ন্যায় পেতে প্রশাসনের নয়, দুর্বৃত্ত প্রভাবশালীর দ্বারস্থ হতে হয়, তখন তাকে আর কী-ই বা বলা যাবে— রাজ্য সরকারের চূড়ান্ত ব্যর্থতা ছাড়া!
কত দূর সাহস ও স্পর্ধা থাকলে এক জন জমি-ব্যবসায়ী এলাকার একচ্ছত্র অধিপতি হয়ে উঠতে পারে, প্রশ্ন শুধু সেটাই নয়। আসল কথাটি হল, প্রশাসন ও পুলিশেরও কল্যাণহস্ত ছাড়া এই দুর্বৃত্তদের বাড়বাড়ন্ত কখনও সম্ভব নয়। সাম্প্রতিক কালে দুর্নীতি ও দুষ্কৃতির যে উদাহরণগুলি পশ্চিমবঙ্গকে নাড়িয়ে দিয়েছে তার প্রতিটি ক্ষেত্রে এই আঁতাঁত স্পষ্ট প্রমাণিত, যে কারণে একের পর এক আইন ভাঙলে বা অপরাধ করলেও তাদের বিরুদ্ধে পুলিশ অভিযোগ নেয় না, স্থানীয় প্রশাসন উদাসীনতা দেখায় কিংবা সমঝোতা করে নিতে বলে। এখনকার পশ্চিমবঙ্গে এ এক প্রকাশ্য গোপন— জেলায় জেলায়, পাড়ায় পাড়ায় নাগরিকরা বুঝেই গিয়েছেন সমাজের স্বঘোষিত মাতব্বর কারা; কোন শাহজাহান জামাল বা জয়ন্তদের অঙ্গুলিহেলনে পুকুর বোজানো বা পুকুরচুরি হয়, কারা দিনের পর দিন নারী নির্যাতন, ধর্ষণ, প্রাণের ভয় দেখানোর মতো জঘন্য সব অপরাধ করে গেলেও আখেরে পার পেয়ে যাবে। এই অনাচার চলছে স্থানীয় প্রশাসনের চোখের সামনে, পুলিশও তা বিলক্ষণ জানে। অন্যায়কে ক্রমাগত আশ্রয় ও প্রশ্রয় দিয়ে চলা যে আরও কত বড় অন্যায়, প্রশাসন যে তখন দুঃশাসনের নামান্তর— এ কথা কি নাগরিক বোঝেন না বলে মনে করে সরকার?
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)