Advertisement
০৩ মে ২০২৪
Refugees

অপরাধ

জুনের শেষে সাড়ে সাতশোরও বেশি শরণার্থী-ভরা একটি নৌকা গ্রিসের অদূরে ডুবে তিনশোরও বেশি পাকিস্তানি মানুষের মৃত্যুতে দেশের পার্লামেন্টে হইচই পড়েছিল।

refugee

প্রতিনিধিত্বমূলক ছবি।

শেষ আপডেট: ২০ ডিসেম্বর ২০২৩ ০৭:৫৪
Share: Save:

বছর কেমন গেল সেই সালতামামিতে নজর দিলে বিশ্বের নানা প্রান্তের কয়েকটি ঘটনা-দুর্ঘটনা নিয়ে কথা হবে, ব্যক্তি, রাষ্ট্র, ভূ-রাজনীতি, অর্থনীতির চুম্বকে। কিন্তু রাষ্ট্রপুঞ্জ বার বার যে ‘সঙ্কট’-এর কথা বলছে তা নিয়ে দৃকপাত নামমাত্র: বছর জুড়ে, এমনকি এখনও, এই মুহূর্তেও এশিয়া ও আফ্রিকার নানা দেশ থেকে ইউরোপের উদ্দেশে ভেসে পড়ছেন হাজার হাজার মানুষ। এই শরণার্থীরা ভূমধ্যসাগর পেরিয়ে গ্রিস বা ইটালির মাটিতে পা রাখতে আক্ষরিক অর্থে মরণপণ করছেন, নয়তো সামান্য ডিঙিনৌকা বা মাছ ধরার ট্রলারে কেউ ভূমধ্যসাগর পেরোনোর স্পর্ধা দেখায় না। নৌকা বা জাহাজের অপরিসর গর্ভে কয়েকশো মানুষের ঠাসাঠাসি, পুরুষের পাশাপাশি নারী ও বিভিন্ন বয়সের শিশুদের অনাহারে অর্ধাহারে দিনযাপন, এবং অষ্টপ্রহর প্রকৃতির রোষ, মানুষের ভয়। ঢেউয়ের আছাড়ে টালমাটাল হচ্ছে নৌকা, উল্টে গিয়ে চোখের সামনে সলিলসমাধি ঘটছে প্রিয়জনের, এ সব পেরিয়ে গ্রিস বা ইটালির উপকূলের কাছাকাছি আসতে পারছে যে ক’টি ধ্বস্ত জলযান, তাদের হয় ভিড়তে দিচ্ছে না ইউরোপীয় দেশগুলির উপকূলরক্ষী, বা ত্রাণকাজে করছে গড়িমসি, উপেক্ষা। রাষ্ট্রপুঞ্জের শরণার্থী নিয়ে কাজ করা প্রায় সব সংস্থা ও নানা মানবাধিকার সংস্থার রিপোর্টে জানা যাচ্ছে শিউরে ওঠা তথ্য— মৃত্যুর, অনাদরের, অবহেলার।

কতটা মরিয়া বা নিরুপায় হলে মানুষ জন্মভূমিও ছাড়তে পারে, স্বদেশে যুদ্ধ গৃহযুদ্ধ গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব নিগ্রহ দারিদ্র কোন পর্যায়ে পৌঁছলে স্বদেশের মায়া ও সর্বস্ব ত্যাগ করে অচেনা প্রবাসপথে ভেসে পড়তে পারেন কেউ, বিশ্ববাসীর সে কথা ভাবার প্রয়োজন ছিল— এখনও আছে। রাষ্ট্রে রাষ্ট্রে সম্পর্কে রাজনীতি কূটনীতি অর্থনীতি বড় বালাই, মানবাধিকার ও মানবিকতাও তাতে তল পায় না। তাই ইটালির রাষ্ট্রপ্রধানের নির্দয় অভিবাসী নীতিতে ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রীও শাবাশি দেন, গ্রিসের উপকূলের খুব কাছে এসেও নৌকাডুবিতে অগণিত শরণার্থী মারা গেলে দোষ চাপানোর খেলায় মেতে ওঠে সে দেশের উপকূলরক্ষী বাহিনী। স্বেচ্ছাসেবী বা মানবাধিকার সংস্থাগুলিকে প্যাঁচে ফেলার ক্রমাগত চেষ্টা হয়ে চলেছে কখনও নিয়মের গেরোয়, কখনও অর্থ বা পরিকাঠামোগত সাহায্য কমিয়ে বা তুলে নিয়ে। ইউরোপের সমাজমনেও ক্রমাগত শরণার্থী-বিদ্বেষ জাগিয়ে তুলছে নানা রাষ্ট্র, সেও অতি উদ্বেগের।

জুনের শেষে সাড়ে সাতশোরও বেশি শরণার্থী-ভরা একটি নৌকা গ্রিসের অদূরে ডুবে তিনশোরও বেশি পাকিস্তানি মানুষের মৃত্যুতে দেশের পার্লামেন্টে হইচই পড়েছিল। সেই শোক ও ক্রোধ অচিরেই নির্বাপিত হয়েছে, বছরশেষে তা নিয়ে উচ্চবাচ্য হয়নি। এই পৃথিবী এক অ-স্বাভাবিক অভ্যস্ততায় গ্রস্ত, যেখানে রাশিয়া-ইউক্রেন বা ইজ়রায়েল-প্যালেস্টাইন যুদ্ধ বা ভূমধ্যসাগরে শরণার্থীদের মৃত্যু, তুরস্ক-সিরিয়ার ভয়ঙ্কর ভূমিকম্পে জীবনহানি বা আফ্রিকার গৃহযুদ্ধদীর্ণ দেশে দেশে মানবাধিকারের নিরন্তর ভূলুণ্ঠন— সবই সমান, এবং সমান দ্রুততায় বিস্মরণের যোগ্য। রাষ্ট্রপুঞ্জ জানাচ্ছে, সেপ্টেম্বর পর্যন্ত আড়াই হাজারেরও বেশি শরণার্থী সাগর পেরোতে গিয়ে মারা গেছেন। বছরশেষে সংখ্যাটি কী দাঁড়াল তার আনুমানিক হিসাবও নিশ্চয়ই মিলবে। মৃত ও নিরুদ্দিষ্টকে তবু গোনা যায়— মানুষের অমানবিক বিস্মৃতি আর নীরবতা পরিমাপের অতীত। এই অভ্যস্ততা অপরাধের শামিল।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Refugees Death Europe
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE