Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪
Demonitisation

অ-ন্যায্য

নোট বাতিলের সিদ্ধান্তের চূড়ান্ত গোপনীয়তাও তাকে কার্যকর করতে পারল কি না, সেই আলোচনার গুরুত্বও বর্তমান রায়ে বিন্দুমাত্র কমেনি।

সুপ্রিম কোর্ট।

সুপ্রিম কোর্ট। ফাইল চিত্র।

শেষ আপডেট: ০৫ জানুয়ারি ২০২৩ ০৫:৫৯
Share: Save:

নোট বাতিল প্রসঙ্গে সুপ্রিম কোর্টের পাঁচ বিচারপতির সাংবিধানিক বেঞ্চের সংখ্যাগরিষ্ঠ রায় কি তবে সমগ্র ঘটনাক্রমকেই ন্যায্যতার ছাড়পত্র দিল? তা নয়। আদালতের রায় জানিয়েছে যে, রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কের সঙ্গে যথেষ্ট আলোচনার পরে সিদ্ধান্তটি গৃহীত হয়েছিল, ফলে তাতে অধিকারভঙ্গ ঘটেনি। নোট বাতিলের ঘোষিত উদ্দেশ্যগুলিও ন্যায্য ছিল, এবং নোট বাতিলের প্রক্রিয়ার সঙ্গে সেই উদ্দেশ্যের সঙ্গতি নিয়েও প্রশ্ন নেই। কিন্তু, একই সঙ্গে আদালত জানিয়েছে যে, সেই ঘোষিত উদ্দেশ্যগুলি কতখানি পূরণ হল, তা এই ক্ষেত্রে আদালতের বিচার্য নয়। এ ক্ষেত্রে দু’টি কথা বিশেষ ভাবে উল্লেখ করা প্রয়োজন। এক, অর্থনৈতিক নীতির ক্ষেত্রে ভারতীয় বিচারবিভাগ ধারাবাহিক ভাবেই রক্ষণশীল অবস্থান নিয়েছে। অর্থাৎ, সরকারের কোনও নীতি যদি স্পষ্টত সংবিধানবিরোধী না হয়, তবে আদালত সে ক্ষেত্রে বিশেষ হস্তক্ষেপ করেনি। এই মামলাতেও আদালত জানিয়েছে যে, সরকারের সিদ্ধান্ত যদি প্রাসঙ্গিক তথ্য ও পরিস্থিতির সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ হয়, এবং তা যদি বিশেষজ্ঞদের মতামতের উপর ভিত্তি করে গৃহীত হয়, তবে আদালত সেই সিদ্ধান্তে হস্তক্ষেপ করবে না। এই মামলায় বিচার্য— অর্থাৎ, প্রক্রিয়াটি আইনগত ভাবে সিদ্ধ ছিল কি না— আদালতকে যে পরিসর দিয়েছিল, এই রায় শুধু সেইটুকুতেই সীমাবদ্ধ। দ্বিতীয় কথা হল, নোট বাতিলের ছ’বছর পরে সেই প্রক্রিয়ার আইনি সিদ্ধতা ব্যবহারিক ভাবে খুব প্রাসঙ্গিক বিষয় নয়। ফলে, ৫৮টি পিটিশনের পরিপ্রেক্ষিতে আদালতের এই রায় এক অর্থে সেই প্রশ্নের উপরে আপাতত যবনিকা টানল।

কিন্তু, নোট বাতিল নিয়ে মূল প্রশ্নটি তো আদৌ তার প্রক্রিয়াগত আইনি সিদ্ধতা নয়। কোনও সিদ্ধান্ত আইনি কি না, সেটাই তার চূড়ান্ত বিচার হতে পারে না— দেখা দরকার, সিদ্ধান্তটি আদৌ ন্যায্য কি না। তাঁর ভিন্নমত রায়ে বিচারপতি নাগরত্ন ন্যায্যতাসংক্রান্ত তেমনই একটি প্রশ্ন উত্থাপন করেছেন। তিনি বলেছেন, সংসদকে এড়িয়ে এমন সিদ্ধান্ত করা চলে না, কারণ সংসদ দেশের নাগরিকের প্রতিনিধিত্ব করে, “সংসদের মাধ্যমেই নাগরিক গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করেন।” বিচারপতি নাগরত্নর কথার রেশ ধরেই বলা চলে যে, নোট বাতিলের প্রক্রিয়ায় কর্তৃত্ববাদী শাসনের ছাপ স্পষ্ট ছিল। আদালতের সংখ্যাগরিষ্ঠ রায় এই সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে গোপনীয়তা ও দ্রুততার গুরুত্বের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছে। কেউ বলতেই পারেন, আইনসভায় আলোচনার মাধ্যমে এ-হেন সিদ্ধান্ত হলে তার আদৌ কোনও কার্যকারিতা থাকত না। সে ক্ষেত্রে ন্যায্যতার দ্বিতীয় আপত্তিটি উত্থাপিত হয়— প্রক্রিয়ার কার্যকারিতা, না কি গণতন্ত্রের সম্মানরক্ষা, রাষ্ট্র কোনটিকে অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচনা করবে, এবং কেন।

নোট বাতিলের সিদ্ধান্তের চূড়ান্ত গোপনীয়তাও তাকে কার্যকর করতে পারল কি না, সেই আলোচনার গুরুত্বও বর্তমান রায়ে বিন্দুমাত্র কমেনি। হিসাব বলছে যে, নোট বাতিলের সময় ১০০০ এবং ৫০০ টাকার নোটে মোট যত টাকা খোলাবাজারে ছিল, তার ৯৯.৩ শতাংশই ফিরে এসেছে রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কে। অর্থাৎ, কালো টাকা ধ্বংস করার ঘোষিত উদ্দেশ্যটি সফল হয়নি। বাজারে নগদের পরিমাণে রাশ টানার উদ্দেশ্যটিও ব্যর্থ— নোট বাতিলের সময় বাজারে মোট নগদের পরিমাণ ছিল ১৭.৭৪ লক্ষ কোটি টাকা; ছ’বছর পরে, ২০২২ সালের ডিসেম্বরে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩২.৪২ লক্ষ কোটি টাকায়। ভারতে ডিজিটাল লেনদেনের প্রচলন বেড়েছে, এবং নোট বাতিল সে ক্ষেত্রে ইতিবাচক অনুঘটকের কাজ করেছে, তা সত্য— কিন্তু, সেই ‘সাফল্য’ এত মানুষের বিপুল সমস্যা, দেশের অসংগঠিত ক্ষেত্রের কোমর ভেঙে যাওয়া, এবং অর্থব্যবস্থার সার্বিক বিপন্নতার মূল্যে অর্জন করা ন্যায্য সিদ্ধান্ত কি না, সেই আলোচনাটি চালিয়ে যেতে হবে। গণতন্ত্রের স্বার্থেই।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Demonitisation Supreme Court
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE