—প্রতিনিধিত্বমূলক ছবি।
তরুণ উপনন্দের প্রভু গতকাল রাত্রে বিদায় নিয়েছেন। স্বনামধন্য লক্ষেশ্বরের কাছে অনেক ঋণ রেখে গিয়েছেন তিনি। সেই ঋণশোধ না করে উপনন্দের ছুটি নেই। তাই সে গাছের তলায় বসে একমনে পুঁথি নকল করে চলেছে। ওটাই তার কাজ, যে কাজে নিয়োজিত শ্রমশক্তির মূল্যে প্রভুঋণ মেটাবে সে। তা দেখে অভিভূত সন্ন্যাসী অপূর্বানন্দ বলেন, “লেখো, লেখো বাবা, তুমি লেখো, আমি দেখি। তুমি পঙ্ক্তির পর পঙ্ক্তি লিখছ, আর ছুটির পর ছুটি পাচ্ছ।”— রবীন্দ্রনাথ তাঁর শারদোৎসব নাটকে বড় যত্ন করে এই দৃশ্যটি এঁকেছিলেন। কেবল দৃশ্য তো নয়, এ তাঁর দর্শন। ১৩২৬ বঙ্গাব্দে শান্তিনিকেতনে এই নাটকের অভিনয় উপলক্ষে এক প্রবন্ধে লিখেছিলেন তিনি: প্রভুর ঋণ শোধের জন্য উপনন্দের অক্লান্ত আত্মোৎসর্গের সৌন্দর্যটি উপলব্ধি করেই রাজসন্ন্যাসীর মনে হল, “শারদোৎসবের মূল অর্থটি এই ঋণশোধের সৌন্দর্য।” প্রকৃতি তার অন্তরে যে অমৃতশক্তি পেয়েছে, শরতের দু’কূলপ্লাবী নদী আর শস্যশ্যামলা খেতের মধ্যে দিয়ে সেই ঋণ সে শোধ করে। আবার, দেবতা মানুষকে যা দিয়েছেন, সে ‘অক্লান্ত তপস্যার অকৃপণ ত্যাগের দ্বারা’ তা পরিশোধ করে আপন দেবতাকে বলে: তোমারে যা দিয়েছিনু সে তোমারই দান। উপনন্দের প্রতি রাজসন্ন্যাসীর উক্তির ব্যাখ্যা করে রবীন্দ্রনাথ তাঁর প্রবন্ধে বলেন, “নিজের মধ্যে অমৃতের প্রকাশ যতই সম্পূর্ণ হইতে থাকে ততই বন্ধন মোচন হয়; কর্মকে এড়াইয়া, তপস্যায় ফাঁকি দিয়া, পরিত্রাণলাভ হয় না।” বৈরাগ্যসাধনে নয়, সারা জীবন যিনি অসংখ্য বন্ধন মাঝে মহানন্দময় মুক্তির স্বাদ খুঁজে ফিরেছিলেন, তাঁর কাছে প্রকৃতি এবং মানুষ উভয়েরই সার্থকতা ‘ঋণশোধ’-এর পরিশ্রমী সাধনায়। শারদোৎসব এই দর্শনের উদ্যাপন, শ্রমসাধনার মধ্য দিয়েই সেই উদ্যাপনের নৈতিক অধিকার অর্জিত হতে পারে, অন্য পথ নেই।
সেই দিগন্তপ্রসারী নৈতিকতার সঙ্গে আজকের কলরবমথিত আড়ম্বরসর্বস্ব বাণিজ্যকবলিত শারদীয় উৎসবের প্রায় কোনও সম্পর্কই আর অবশিষ্ট নেই— এই আক্ষেপটুকুও বোধ করি এখন অর্থহীন, অবান্তর। অতএব আশ্বিনের শারদপ্রাতে ভরসা থাকুক রবীন্দ্রনাথের উৎসব-ভাবনাতেই। বিশেষত ভরসা থাকুক সেই ভাবনার একটি মাত্রায়, একটু খেয়াল করলে যা খুঁজে নেওয়া যায় তাঁর নাটকের ওই দৃশ্যটিতে। ঋণ শোধের মহিমা বর্ণনার পরেই রাজসন্ন্যাসী উপনন্দকে বলেন, “তোমার এত ছুটির আয়োজন আমরা তো পণ্ড করতে পারব না। দাও বাবা, একটা পুঁথি আমাকে দাও, আমিও লিখি। এমন দিনটা সার্থক হোক।” এবং সেই কথা শুনে ছেলের দল নিয়ে শারদীয় ছুটির নিমন্ত্রণে বেরিয়ে পড়া ঠাকুরদাদাও “আছে আছে, চশমাটা ট্যাঁকে আছে, আমিও বসে যাই না” বলে একখানা পুঁথি বাগিয়ে নেন, আর সঙ্গে সঙ্গে বালকরাও জানিয়ে দেয়, “ঠাকুর, আমরাও লিখব।” অতঃপর সবাই মিলে এক আশ্চর্য কথামালা তৈরি করে, যার শেষে শোনা যায় শিশুকণ্ঠের আনন্দময় ঘোষণা: “আজ লেখা শেষ করে দিয়ে তবে উপনন্দকে নিয়ে নৌকো-বাচ করতে যাব। বেশ মজা!”
কাজ শেষ করে ছুটি উপভোগের মধ্যেই ঋণ শোধের প্রকৃত আনন্দ— এই জীবনদর্শনের সঙ্গে এখানেই ওতপ্রোত হয়ে আছে আরও একটি গভীর বাণী। মানুষের সঙ্গে মানুষের মিলনের বাণী। সেই মিলন কেবল বাইরের নয়, অন্তরের। তা কেবল উৎসবের নয়, কর্তব্যের। উপনন্দ একা বসে বসে তার ঋণ শোধ করবে আর অন্যরা নৌকা বাইচ করতে যাবে, এমনটা হতেই পারে না। সকলে যে আনন্দের ভাগ নিতে পারবে না, সে কিসের আনন্দ? সর্বজনীন শারদোৎসবকে সার্থক করে তুলতে হলে ঋণ শোধের কাজটাও সর্বজনীন হওয়া চাই। এই ভাবেই রবীন্দ্রনাথ তাঁর সর্বজনীনতার ধারণাটিকে রাজসন্ন্যাসী এবং ঠাকুর্দার কথায় ও কাজে রূপ দিয়েছেন, বালকের দল স্বতঃস্ফূর্ত আনন্দের টানে তার অনুশীলনে শামিল হয়েছে। শতাব্দী অতিক্রান্ত হওয়ার পরে আজ সেই অনুশীলন যতটা জরুরি, ততটাই কঠিন। শারদোৎসবের আনন্দ এখন বহুলাংশেই বিচ্ছিন্ন মানুষের উল্লাস, সেই মানুষের পারস্পরিক মিলন প্রধানত লেনদেনের অনন্ত বাজারে, কোন মণ্ডপে কত ভিড় হল তার পরিসংখ্যানেই সর্বজনীনতার ভরসা-ফুর্তি। পঞ্জিকার নিয়মে উৎসবের দিনক্ষণ নির্ধারিত হয়, বাজারের নির্দেশে তার দিনগণনা চলতে থাকে, যথাকালে মণ্ডপ সেজে ওঠে, দেবী আসেন, ভিড় জমে, দীর্ঘায়িত ছুটির মরসুম জমে ওঠে, উপনন্দ মলিন মুখে ঋণ শোধ করে চলে, তাকে একাকী এবং বিচ্ছিন্ন রেখেই বালকেরা নৌকা বাইচ করতে চলে যায়। শৃণ্বন্তু বিশ্বে— বঙ্গসমাজের দুয়ারে শারদোৎসব সমাগত।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy