E-Paper

ফাঁক ও ফাঁকি

ষোলো লক্ষের মতো ছাত্রছাত্রী স্কুলের পাঠ শুরু করত, শেষ করত প্রায় সাড়ে দশ লক্ষ। এ থেকে শিক্ষা-বঞ্চনার একটা ধারাবাহিকতা রয়েছে পশ্চিমবঙ্গে।

শেষ আপডেট: ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ ০৬:২৪
A Photograph of a classroom

প্রতি বছর স্কুলের শেষ পরীক্ষা থেকে ‘মিসিং’ বা উধাও থাকছে কমবেশি ছ’লক্ষ ছাত্র। ফাইল ছবি।

মাধ্যমিক পরীক্ষার্থীর সংখ্যা কমেছে চার লক্ষ। স্কুল শিক্ষার মানরক্ষায় কতখানি ব্যর্থ রাজ্য সরকার, একে তারই ‘মার্কশিট’ বলা চলে। অতিমারি কালে দু’বছরেরও বেশি সময় স্কুলগুলিকে কার্যত চাল-আলু বিতরণ কেন্দ্র করে রেখেছিল রাজ্য সরকার। অনলাইন শিক্ষা অধিকাংশ শিশুর কাছে পৌঁছয়নি, তার বহু প্রমাণ পাওয়া সত্ত্বেও কোনও বিকল্প ব্যবস্থা হয়নি। শিশুদের লাগাতার স্কুল-বিচ্ছিন্নতার পরিণাম নিয়ে শিক্ষক সংগঠনগুলি বার বার উদ্বেগ প্রকাশ করেছে, সতর্ক করেছেন বিশেষজ্ঞরাও। অর্থনীতিবিদ অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায় মনে করিয়েছেন যে, অতিমারি-জনিত সমস্যাগুলির মধ্যে সবচেয়ে দীর্ঘমেয়াদি হবে শিক্ষার সঙ্কট। এক বছরের মধ্যে চার লক্ষ পরীক্ষার্থী হারিয়ে পশ্চিমবঙ্গ সেই আশঙ্কা সত্য করল। শিক্ষামন্ত্রী আশ্বাস দিয়েছেন যে, এ বছর মাধ্যমিক পরীক্ষার্থীর সংখ্যা কমে যাওয়ার কারণ অনুসন্ধান করবেন বিশেষজ্ঞরা। আশা করা যায়, তাঁরা কেবল ২০২২ সালের তুলনায় ২০২৩ সালের মাধ্যমিক পরীক্ষার্থীর সংখ্যায় ঘাটতি দিয়েই বিষয়টিকে দেখবেন না, পশ্চিমবঙ্গে স্কুলছুটের ধারাবাহিকতাকেও বিবেচনা করবেন। দশ বছর আগে যত শিশু ভর্তি হয়েছিল প্রথম শ্রেণিতে, তাদের কত জন স্কুলের শেষ ধাপ অবধি পৌঁছতে পারল, সেই নিরিখেও স্কুল-শিক্ষার বিচার করা দরকার। তাতে স্পষ্ট হবে যে, মাধ্যমিকে পরীক্ষার্থীর সংখ্যা বরাবরই পশ্চিমবঙ্গে স্কুল-শিক্ষার সীমাবদ্ধতাকে প্রতিফলিত করেছে।

কেন্দ্রীয় সরকারকে প্রদত্ত রাজ্য সরকারের তথ্য (ডাইস রিপোর্ট) অনুসারে, ২০১৩-১৪ সালে বারো লক্ষ ছাত্রছাত্রী ভর্তি হয়েছিল প্রথম শ্রেণিতে। এই সংখ্যা তার পূর্ববর্তী বছরগুলির তুলনায় কিছুটা কম— তার কারণ সম্ভবত শিক্ষার অধিকার আইন (২০০৯) অনুসারে প্রথম শ্রেণিতে ভর্তির বয়সে পরিবর্তন। এই পড়ুয়ারা তৃতীয় শ্রেণিতে পৌঁছলে (২০১৫-১৬) তাদের সংখ্যা প্রায় ত্রিশ হাজার বেড়েছিল, সম্ভবত উপরের শ্রেণিগুলি থেকে কিছু পড়ুয়া যোগ হওয়ার জন্য। এই বারো লক্ষাধিক পড়ুয়ার মধ্যে মাধ্যমিক পরীক্ষায় বসবে ৬ লক্ষ ৯৮ হাজার। অর্থাৎ, দশ জনে ছ’জনও স্কুলের পাঠ শেষ করতে পারল না। অতীতের বছরগুলিতে এই অনুপাত ছিল ষাট শতাংশের সামান্য বেশি— ষোলো লক্ষের মতো ছাত্রছাত্রী স্কুলের পাঠ শুরু করত, শেষ করত প্রায় সাড়ে দশ লক্ষ। এ থেকে স্পষ্ট হয়, শিক্ষা-বঞ্চনার একটা ধারাবাহিকতা রয়েছে পশ্চিমবঙ্গে, অতিমারি তাকে আরও তীব্র করেছে কেবল। প্রতি বছর স্কুলের শেষ পরীক্ষা থেকে ‘মিসিং’ বা উধাও থাকছে কমবেশি ছ’লক্ষ শিশু।

ব্যর্থতা চাপা দিতে নানা তথাকথিত ‘সাফল্য’-র ধুয়ো তোলেন নেতা-আধিকারিকরা। যেমন, ছেলেদের তুলনায় মেয়ে পরীক্ষার্থী বেশি, শহরের তুলনায় গ্রামে পরীক্ষার ভাল ফল, পাশের হারে বৃদ্ধি, ইত্যাদি। মূল যে সমস্যা— প্রতি দশ জনে চার জন শিশুর স্কুল-শিক্ষা অসমাপ্ত থেকে যাওয়া— তা কেবলই চাপা দেওয়া হয়। শিক্ষার অধিকার আইনের দৌড় যে-হেতু অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত, তাই নবম-দশমে শিক্ষা-বঞ্চনার চেহারাটা প্রকট হলেও তা নিয়ে উচ্চবাচ্য করে না রাজ্য। যেন আইনের বাধ্যবাধকতার বাইরে শিশু ও অভিভাবকের প্রতি কোনও দায়বদ্ধতা থাকে না। শিক্ষকদের কাজ, স্কুলগুলিতে পঠনপাঠনের মানের মূল্যায়ন করার রাজনৈতিক সাহসও দেখা যায় না। যে কোনও সরকারি প্রতিষ্ঠানের মতো করেই স্কুলগুলিকে দেখা হচ্ছে, বিবিধ সরকারি প্রকল্পের হিসাব দাখিল করাই যেন শিক্ষকদের কাজ বলে মনে করা হচ্ছে। পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষার হাল আজ এমনই যে, পরীক্ষার পাঠ্যক্রম কাটছাঁট করে, প্রশ্ন সহজ করে, অঢেল নম্বরের আশ্বাস দিয়েও পড়ুয়াদের পরীক্ষার ঘরে আনা যায় না। রাজ্যের শিক্ষাক্ষেত্রে এই অতিকায় ফাঁক চরম উদ্বেগজনক।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Secondary Education School students Education Board madhyamik exam

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy