সুপ্রিম কোর্ট। —ফাইল চিত্র।
সংবাদমাধ্যম নিজেকে বিচারকের আসনে বসানোর ফলে বিচারের গোটা প্রক্রিয়াটিতেই বড় রকমের ব্যাঘাত ঘটছে— এই বিষয়ে সুপ্রিম কোর্ট গভীর উদ্বেগ জানিয়েছে। উদ্বেগ অসঙ্গত নয়। এ দেশে সুবিচারের পথে অনেক ধরনের বাধাবিপত্তি থাকে, বিশেষত প্রশাসনের অপদার্থতা এবং পক্ষপাতিত্ব অনেক সময়েই খুব বড় সমস্যা সৃষ্টি করে। সংবাদমাধ্যম অসংযত বা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত আচরণ করলে পরিস্থিতি নিশ্চয়ই আরও জটিল হয়ে পড়ে, বিশেষত যখন সেই আচরণ ‘মিডিয়া ট্রায়াল’-এর রূপ ধারণ করে এবং তার ফলে জনমত প্রভাবিত হয়। মহামান্য বিচারপতিরা সংবাদমাধ্যমকে ‘যথাযথ, পক্ষপাতমুক্ত এবং দায়িত্বশীল’ হওয়ার যে পরামর্শ দিয়েছেন, তা অবশ্যই অত্যন্ত মূল্যবান। তাঁদের প্রাজ্ঞ অভিমতের প্রতি সম্পূর্ণ শ্রদ্ধা রেখেই একটি প্রশ্ন গণতন্ত্রের স্বার্থেই পেশ করা দরকার। সংবাদমাধ্যম তথা সাংবাদিকদের স্বাধীনতা যাতে কোনও ভাবে খর্বিত না হয়, সেই বিষয়ে যথেষ্ট সতর্ক থাকাও কি অত্যাবশ্যক নয়? সংবাদ ও মতামত পরিবেশনে দায়িত্বশীল হওয়া অবশ্যই জরুরি, কিন্তু দায়িত্বশীলতার নামে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিয়ন্ত্রণের আশঙ্কাই আরও জোরদার হয়ে উঠবে না তো?
আশঙ্কার একটি বিশেষ কারণ আছে। ‘মিডিয়ার বিচার’ প্রতিরোধের জন্য সর্বোচ্চ আদালত কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রককে পুলিশের জন্য বিশেষ নির্দেশিকা তৈরি করতে বলেছে, ফৌজদারি মামলা সংক্রান্ত তথ্য সাংবাদিকদের জানানোর ব্যাপারে পুলিশকে যে নির্দেশিকা মেনে চলতে হবে। এই নির্দেশিকার লক্ষ্য: মামলা তথা বিচার সংক্রান্ত তথ্য যাতে এমন ভাবে সংবাদমাধ্যমে প্রকাশের সুযোগ না থাকে, যার ফলে বিচারের প্রক্রিয়া ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এই বিধানটি প্রণয়নের জন্য বিভিন্ন রাজ্যের পুলিশের মতামত জানতে চাওয়া হয়েছে। গুরুত্বপূর্ণ মামলার খবরাখবর পুলিশ প্রশাসন কী ভাবে জানাবে, সে সম্পর্কে স্বভাবতই লিখিত বা অলিখিত আচরণবিধি জারি থাকে, সংবাদমাধ্যমগুলিকেও বিচারাধীন মামলা বা অভিযোগের বিষয়ে কতখানি কী ভাবে প্রকাশ করা যাবে সেই বিষয়ে সতর্ক থাকতে হয়। পুলিশ, প্রশাসন এবং সংবাদমাধ্যম— সমস্ত পক্ষেরই এ ব্যাপারে দায়িত্বশীল থাকা দরকার। প্রশ্ন হল: প্রশাসন সেই দায়িত্বশীলতার মাপকাঠি নির্ধারণের নতুন সুযোগ পেলে তার অপব্যবহারের আশঙ্কা বাড়বে না তো? আরও নির্দিষ্ট করে বলা যায়, পুলিশ যদি এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে এবং আদালতের সতর্কবাণীর দোহাই দিয়ে সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে অসহযোগিতা করে বা তাকে নিপীড়ন করে? ‘মিডিয়া ট্রায়াল’ নিবারণের নামে শাসকদের পক্ষে অস্বস্তিকর খবর প্রকাশ না করে? কোনও সংবাদমাধ্যমে তেমন খবর প্রকাশিত হলে যদি ‘বিধি লঙ্ঘন’-এর নামে তার বিরুদ্ধে সক্রিয় হয়?
এই মুহূর্তে ভারতের পরিস্থিতির কারণেই এত উদ্বেগ তৈরি হচ্ছে। দেশের শাসক সমাজ যদি গণতন্ত্রের স্বাভাবিক পথে সুস্থিত থাকতেন, তা হলে এতখানি আশঙ্কার বিশেষ কোনও কারণ থাকত না। কিন্তু সমকালীন ভারতের বাস্তব তার বিপরীত। কেন্দ্রীয় শাসকরা তো বটেই, বিভিন্ন রাজ্যেও ক্ষমতাসীন দল বা তাদের নায়কনায়িকারা মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে খর্ব করতে সর্বদাই অতিব্যস্ত। সংবাদমাধ্যম তাঁদের বশংবদ হলে শাসকরা পরম সন্তুষ্ট থাকেন, না হলে, বিশেষত সমালোচনা করলে, চরম কুপিত হন। সেই কোপ এসে পড়ে নানা মাত্রায়, নানা আকারে। ‘মিডিয়ার বিচার’ নামক সমস্যার মোকাবিলা করতে গিয়ে শাসকদের এই নিপীড়নের প্রবৃত্তি এবং ক্ষমতা আরও জোরদার হয়ে উঠলে সেই ‘সমাধান’ সমস্যার থেকেও ভয়ঙ্কর হয়ে উঠতে পারে। সর্বোচ্চ আদালতের মাননীয় বিচারকরা, আশা করা যায়, এই প্রশ্ন গভীর ভাবে বিবেচনা করবেন। প্রশ্নটি বিপন্ন গণতন্ত্রকে রক্ষা করার— সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা যে গণতন্ত্রের অন্যতম প্রধান রক্ষাকবচ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy