Advertisement
০১ মে ২০২৪
West Bengal Panchayat Election 2023

হিংসাপ্রমত্ত

এ বারের পঞ্চায়েত নির্বাচন ঘোষণার পর থেকে ভোটের দিন অবধি হিংস্র রাজনীতি নিরবচ্ছিন্ন প্রমত্ততায় গণতন্ত্রের কাঠামোয় প্রবল আঘাত চালিয়ে গিয়েছে।

Panchayat Election.

পশ্চিমবঙ্গে নির্বাচনী হিংসার পরম্পরাটি এই জমানায় এক চরম আকার ধারণ করেছে। ছবি: পিটিআই।

শেষ আপডেট: ১০ জুলাই ২০২৩ ০৫:৫৬
Share: Save:

একটি মৃতদেহ ঘিরে কান্নায় ভেঙে পড়া স্বজনবান্ধব। এক নারীর আকুল কান্না। রক্তাক্ত একটি মুখ। এক আগ্নেয় অস্ত্রধারীর আস্ফালন।— পশ্চিমবঙ্গের পঞ্চায়েত নির্বাচনের পরের সকালে সংবাদপত্রের প্রথম পাতায় ভোটপর্বের কয়েকটি ছবি। এই রাজ্যে গণতন্ত্রের চালচিত্র। ভয়ঙ্কর, কিন্তু ভয়ঙ্কর সত্য। এই সত্যে শাসকদের প্রবল অরুচি। রাজ্যের প্রবীণ মন্ত্রী সুগম্ভীর বাণী বিতরণ করেছেন: কিছু বিচ্ছিন্ন অশান্তিকে বড় করে দেখিয়ে পশ্চিমবঙ্গের ভাবমূর্তি নষ্ট করা হচ্ছে। অর্থাৎ, শান্তিপূর্ণ, নিরুপদ্রব, সুশৃঙ্খল ভোটের লাইন দেখালেই সেই ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হত। সেই উজ্জ্বল মূর্তির আড়ালে ওই ভয়ঙ্কর সত্যের চিত্রগুলিকে গোপন করলে যে প্রগাঢ়তম মিথ্যাকে প্রশ্রয় দেওয়া হয়, শাসকরা সেই মিথ্যাকেই প্রতিষ্ঠিত করতে চান। তার কারণ, সত্য তাঁদের পক্ষে নেই। সত্য এই যে, পশ্চিমবঙ্গে নির্বাচনী হিংসার পরম্পরাটি এই জমানায় এক চরম আকার ধারণ করেছে। এ বারের পঞ্চায়েত নির্বাচন ঘোষণার পর থেকে ভোটের দিন অবধি সেই হিংস্র রাজনীতি নিরবচ্ছিন্ন প্রমত্ততায় গণতন্ত্রের কাঠামোয় প্রবল আঘাত চালিয়ে গিয়েছে। ভোট মিটলেও সেই তাণ্ডবের অবসান হবে, রক্তস্রোত এবং প্রাণহানি থামবে, এমন কোনও ভরসা নাগরিকের নেই, কারণ এই আদিগন্ত অরাজকতায় ভরসার কিছুমাত্র কারণ নেই।

শনিবার সারা দিন রাজ্যের বহু অঞ্চলে যে তাণ্ডব দেখা গেল, তা এক অর্থে চূড়ান্ত অরাজকতার বিজ্ঞাপন। রাজ্যের পুলিশ প্রশাসনের উপর কেবল বিরোধী দলের নয়, বৃহত্তর সমাজের আস্থা কোন তলানিতে ঠেকেছে, সেই প্রসঙ্গ বহুচর্চিত। সেই পরিপ্রেক্ষিতেই কেন্দ্রীয় বাহিনী নিয়ে গত এক মাস ধরে এত টানাপড়েন। অথচ ভোটের দিন অধিকাংশ ক্ষেত্রে সেই বাহিনীকে কার্যত খুঁজেই পাওয়া গেল না! কেন এমনটা ঘটল, তা নিয়ে নির্বাচন কমিশন এবং কেন্দ্রীয় বাহিনীর কর্তাদের মধ্যে রকমারি চিঠি চালাচালির সংবাদ জেনে নাগরিকরা ধন্য হলেন, ঠিক যেমন তাঁদের চমৎকৃত করল এই বিষয়ে রাজ্যের শাসক ও কেন্দ্রের শাসকদের সওয়াল-জবাব। বুথের পর বুথে নাগরিকরা, এবং বিভিন্ন দলের— গুন্ডাবাহিনী নয়— যথার্থ ভোটকর্মীরা আক্রান্ত অথবা সন্ত্রস্ত হয়ে নিরাপত্তারক্ষীদের সাহায্য চেয়ে বিফল হলেন, অথবা তাঁদের দেখাই পেলেন না। এবং, গোটা নির্বাচন পরিচালনার দায়িত্ব হাতে নিয়ে যিনি পঞ্চায়েত ভোট ঘোষণার পূর্বলগ্নে আসন গ্রহণ করেছিলেন, সেই রাজ্য নির্বাচন কমিশনার তাঁর এক মাসের বিচিত্র আচরণের ধারাবাহিকতা বজায় রেখে দিনের শেষে অম্লানবদনে জানিয়ে দিলেন, তাঁর কাজ কেবলমাত্র (ভোটের) ‘ব্যবস্থা করা’, আর ‘কে কাকে গুলি করে দেবে, কাকে মেরে দেবে’ সে-কথা কেউ বলতে পারে না। ভরসা? এর পরেও?

রাজনীতির ময়দান থেকে সামাজিক সংলাপ ও তরজার পরিসর অবধি সর্বত্র এই হিংস্রতার দায়ভাগ নিয়ে নিরন্তর বিতণ্ডা চলেছে। শনিবারের ঘটনাবলিতেও কোথায় কোন দলের লোকেরা কতটা উপদ্রব করেছে তা নিয়ে শোরগোলের বিরাম নেই। বিশৃঙ্খলার দোহাই দিয়ে রাজ্যের প্রশাসনে কেন্দ্রীয় সরকারের হস্তক্ষেপ চাইবার প্রাচীন আওয়াজ তুলতে বিরোধীদের একাংশ যথারীতি তৎপর, শাসক দল ছাপ্পা ভোট দিলে ব্যালট বাক্স জলে (প্রয়োজনে নর্দমার জলে) ফেলে দেওয়ার আহ্বান জানাতেও তাঁরা পিছপা নন। গণতন্ত্রের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ বা দায়িত্বজ্ঞানের অসামান্য নমুনা বটে! কিন্তু সে-সবই গৌণ। মুখ্য প্রশ্ন একটাই: ভোট মানেই হিংসার উন্মত্ত অনুশীলন— গোটা দেশের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গেই এই বাস্তব কেন এমন ভাবে কায়েম হল? এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার দায় রাজ্যের শাসকদের, কারণ দীর্ঘ বারো বছর তাঁরাই ক্ষমতার আসনে অধিষ্ঠিত। তাঁদের উদ্দেশে রাজ্যের নাগরিকদের একটাই দাবি: ছেঁদো কথা রাখুন, পশ্চিমবঙ্গে শেষ হোক দুঃশাসনের পালা। এই কুৎসিত তাণ্ডব নাগরিক সমাজের সহ্যের মাত্রা অতিক্রম করে গিয়েছে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

West Bengal Panchayat Election 2023 Violence
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE