E-Paper

যন্ত্রমেধার বিড়ম্বনা

কঠিনতর একটি প্রশ্নও আছে বইকি। সেই প্রশ্ন সৃষ্টিশীলতার। যান্ত্রিক প্রযুক্তি ক্রমশই নানা ‘মানবিক’ কাজ করে দিচ্ছে, এমনকি লেখালিখি বা ছবি আঁকার মতো শিল্পসৃষ্টির পরিসরেও যন্ত্রমেধার প্রয়োগ ঝড়ের গতিতে বেড়ে চলেছে।

শেষ আপডেট: ২২ জুন ২০২৪ ০৮:০৪

—প্রতীকী ছবি।

আইসক্রিম কিনতে চেয়ে কেউ পেয়েছেন রকমারি মাখনের সম্ভার! কারও কাছে আইসক্রিম এসেছে, তার শিখরে বিরাজমান একটি বেকনের টুকরো! আবার বহু ক্রেতার কাছে অর্ডার মাফিক খাদ্যসামগ্রী ঠিকঠাক পৌঁছেছে বটে, কিন্তু যে খাবারই হোক, তার সঙ্গে এসেছে বাড়তি ‘চিকেন নাগেট’, নিখরচায়! বেশ কিছু কাল যাবৎ যে সংস্থার কাছে খাবার কিনতে গিয়ে ক্রেতারা এমন সব অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়েছেন, সেটি আমেরিকার এক ডাকসাইটে ‘ফাস্ট ফুড চেন’, দুনিয়া জুড়ে যাদের বহু দশকের বিপুল কারবার। কী কারণে এই ধরনের গোলযোগ? এক কথায় উত্তর: এআই, অর্থাৎ আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, অথবা যন্ত্রমেধা। ‘ভয়েস রেকগনিশন’ অর্থাৎ কণ্ঠস্বর শুনে এবং বুঝে সেই অনুসারে কাজ করার প্রযুক্তি উত্তরোত্তর উন্নত হচ্ছে, তার ব্যবহারের পরিসরও সমান তালে প্রসারিত হয়ে চলেছে। যন্ত্রমেধার সাহায্যে ক্রেতাদের অর্ডার ‘শুনে’ সেই অনুসারে খাবার সরবরাহের ব্যবস্থা চালু করেছিল ওই সংস্থা। সেই ব্যবস্থাটিতেই দেখা দিয়েছে এমন সব বিভ্রাট, অধুনা যা সমাজমাধ্যমের কল্যাণে ‘ভাইরাল’ সংবাদের উপজীব্য। শ’খানেক বিপণিতে যন্ত্রমেধার ব্যবহার আপাতত বন্ধ হতে চলেছে। তবে সংস্থাটি জানিয়েছে, আপাততই। যন্ত্রমেধার ঢাকি সমেত বিসর্জনের কথা তারা ভাবছে না।

যন্ত্রমেধার সাহায্যে ক্রেতাদের কথা বুঝতে ভুল হচ্ছে বিভিন্ন কারণে। একট বড় কারণ উচ্চারণের বৈচিত্র। যে সব ধরনের উচ্চারণ শুনিয়ে প্রযুক্তিকে অভ্যস্ত এবং প্রস্তুত করা হয়েছে, কোনও ক্রেতার কথা তার ছকে ধরা না পড়লে যন্ত্রমেধা আর তার যথাযথ অর্থ উদ্ধার করতে পারছে না। ‘ধান’ শুনতে ‘কান’ শোনার পুরনো সমস্যাই এখন নতুন রূপ ধারণ করে আইসক্রিমে মাংসের টুকরো জুড়ে দিচ্ছে। আবার, ক্রেতা যখন টেলিফোনে তাঁর বরাত দিচ্ছেন সেই সময় চার পাশে অন্য আওয়াজ থাকলে যন্ত্রমেধা বিভ্রান্ত হচ্ছে, এমন নজিরও মিলেছে। লক্ষণীয়, এই সব ক্ষেত্রেই যন্ত্রমেধার ব্যর্থতার মূল কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে তার বুদ্ধিমত্তার যান্ত্রিকতা। উচ্চারণই হোক আর চার পাশের কোলাহলই হোক, শেখানো বিদ্যার বাইরে কাজ করতে হলেই সে বিপদে পড়ছে। বলা বাহুল্য, ক্রমাগত অনুশীলন এবং পরিমার্জনের মধ্য দিয়ে এই সব ঘাটতি উত্তরোত্তর কমছে এবং কমবে, ছক ভাঙা বৈচিত্রকেও ক্রমশই আরও প্রসারিত ছকের আওতায় নিয়ে আসা হবে। কিন্তু সেই প্রক্রিয়া কখনওই সম্পূর্ণ হবে কি? মানুষী বিভিন্নতা এবং অনিশ্চয়তার ষোলো আনা নাগাল প্রযুক্তি পাবে কি? কঠিন প্রশ্ন।

কঠিনতর একটি প্রশ্নও আছে বইকি। সেই প্রশ্ন সৃষ্টিশীলতার। যান্ত্রিক প্রযুক্তি ক্রমশই নানা ‘মানবিক’ কাজ করে দিচ্ছে, এমনকি লেখালিখি বা ছবি আঁকার মতো শিল্পসৃষ্টির পরিসরেও যন্ত্রমেধার প্রয়োগ ঝড়ের গতিতে বেড়ে চলেছে। যথার্থ সৃষ্টিশীলতা এর ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হতে বাধ্য। সৃষ্টির নানা ক্ষেত্রে সেই ক্ষতির নানা লক্ষণ ইতিমধ্যেই প্রকট। সরাসরি যন্ত্রমেধার সাহায্যে নকল সৃষ্টির প্রবঞ্চনা তো আছেই, তবে এক অর্থে আরও অনেক বেশি বিপজ্জনক হল কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সাহায্যে কাজ হাসিল করে নেওয়ার রীতি, যা ক্রমশই ‘স্বাভাবিক’ বা এমনকি ‘বাস্তবসম্মত’ বলে গণ্য হচ্ছে। সেই কারণেই অধুনা বলিভিয়া নিবাসী এক আলোকচিত্রীর সাম্প্রতিক এক কৃতি ভরসা দেয়। যন্ত্রমেধার জন্য নির্দিষ্ট একটি প্রতিযোগিতায় পুরস্কৃত হয়েছে তাঁর তোলা একটি ছবি। ফল ঘোষণার পরে তিনি জানিয়ে দিয়েছেন যে পুরস্কৃত ছবিটি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সৃষ্টি নয়, তাঁর নিজের তোলা, সুতরাং যন্ত্রমেধার জন্য বরাদ্দ এই পুরস্কার তিনি গ্রহণ করতে পারেন না। কিন্তু এই সাফল্যের মধ্য দিয়ে তিনি ‘প্রমাণ’ করেছেন যে, যন্ত্রমেধার নিজস্ব ভুবনেও মানুষ সফল হতে পারে। লোককথায় ও লোকগানে প্রসিদ্ধ জন হেনরির প্রতিধ্বনি করে সে উন্নতশিরে বলতে পারে: আমি মেশিনের হব প্রতিদ্বন্দ্বী। আপাতত এইটুকুই ভরসা।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Artificial Intelligence Technology Science

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy