E-Paper

সবাই রাজা

বিশ্বাসের সেই উত্তরাধিকার বহনের দায় বর্তমানের— সেই বিশ্বাসকে ভবিষ্যতের জন্য অক্ষত রাখার দায়ও।

শেষ আপডেট: ২৬ জানুয়ারি ২০২৪ ০৮:২১
flag

—ফাইল চিত্র।

২৬ জানুয়ারি তারিখটিকেই কেন ভারতে সংবিধান প্রবর্তনের দিন হিসাবে বেছে নেওয়া হয়েছিল, সেই প্রশ্নের উত্তর রয়েছে ১৯৫০-এর দুই দশক পূর্বের এক ২৬ জানুয়ারি তারিখে। ১৯৩০ সালে এই দিনই পূর্ণ স্বরাজ ঘোষিত হয়— ১৯৪৭-এর আগে পর্যন্ত জাতীয়তাবাদীদের কাছে ‘স্বাধীনতা দিবস’ ছিল এই দিনটিই। ভারতের জাতীয়তাবাদী রাজনীতির প্রগতিশীল অংশ সচেতন ছিলেন যে, স্বাধীনতাকে যদি অর্থপূর্ণ করতে হয়, তা হলে দেশের প্রতিটি মানুষকে স্বাধীনতা দিতে হবে— জীবিকার স্বাধীনতা, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, মেলামেশার স্বাধীনতা, এবং দেশ শাসনের স্বাধীনতা। দেশের প্রতিটি মানুষের সমান অধিকার থাকবে— শুধু দেশের শাসককে বেছে নেওয়ার নয়— দেশের শাসক হওয়ার। কোনও বিশেষ ক্ষমতাবলে নয়, ভারতের নাগরিক হিসাবে পরিচিতিটুকুই দেশের শাসক হওয়ার পক্ষে যথেষ্ট, ভারতীয় প্রজাতন্ত্র নাগরিককে এই অধিকার দিয়েছে। অর্থাৎ, দেশের শাসকের সঙ্গে মানুষের সম্পর্কটি রাজা ও প্রজার নয়, নাগরিকের সঙ্গে নাগরিকের। সেখানে উচ্চাবচতা নেই, সমাসন রয়েছে। প্রজাতন্ত্রের ধর্ম হল, ‘রাজা’কে যদি মান পেতে হয়, তবে সবাইকে মান দিতে হবে। ১৯৫০ সালের ২৬ জানুয়ারি ভারতে ‘সবাই রাজা’-র শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।

তার পরের সাড়ে সাত দশকে সেই আদর্শ সর্বদা রক্ষিত হয়েছে কি না, সেই প্রশ্নে যাওয়ার আগে এক বার ভাবা যায় যে, সাধারণ মানুষের প্রতি কতখানি সহৃদয় সম্মানবোধ থাকলে এমন একটি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা যায়, তার প্রতি নিষ্ঠাবান থাকা যায়। দেশ যখন স্বাধীন হয়, তখন সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ নিরক্ষর, জাত-ধর্মের শৃঙ্খলে বাঁধা, দীর্ঘ দিনের ঔপনিবেশিক শাসন ও তার প্রশ্রয়ে লালিত সামন্ততন্ত্র দেশের মানুষের শিরদাঁড়া বাঁকিয়ে দিয়েছে। এ-হেন জনতার হাতে দেশ পরিচালনার ভার ছাড়া যায়, তার অন্তরে জাগিয়ে তোলা যায় নাগরিক চেতনা, এ কথাটি বিশ্বাস করতে, এবং সেই বিশ্বাসের উপর ভর করে দেশের সংবিধান রচনা করতে এক আশ্চর্য রাজনৈতিক কল্পনাশক্তির প্রয়োজন হয়। প্রজাতন্ত্র দিবসে সেই কল্পনাশক্তিকে, জাতির সেই কারিগরদের কুর্নিশ জানানো বিধেয়— তাঁরা বিশ্বাস করতে পেরেছিলেন যে, ‘আমরা, ভারতের নাগরিকরা’ সত্যিই একটা দেশ গঠনের, সেই দেশ পরিচালনার অঙ্গীকার করতে পারি, সেই সত্যে অধিষ্ঠিত থাকতে পারি।

বিশ্বাসের সেই উত্তরাধিকার বহনের দায় বর্তমানের— সেই বিশ্বাসকে ভবিষ্যতের জন্য অক্ষত রাখার দায়ও। তাঁরা প্রজা নন, নাগরিক, দেশের সমান অংশীদার, এই কারণেই নাগরিকদের দায় প্রজাতন্ত্রের অন্তর্নিহিত সমাসনের ধারণাটিকে বহমান রাখার। প্রধানমন্ত্রী যখন দোল-দুর্গোৎসবে নাগরিকদের ‘উপহার’ দেওয়ার কথা ঘোষণা করেন— কখনও মহিলাদের জন্য গ্যাস সিলিন্ডার, কখনও পেট্রলের দামে ছাড়, কখনও কৃষকদের জন্য মাসোহারা— তখন তাঁকে স্মরণ করিয়ে দেওয়া বিধেয় যে, এটা রাজতন্ত্র নয়, প্রজাতন্ত্র। উপহার বিলি করার অধিকার তাঁর নেই, রাষ্ট্রীয় সম্পদের অছি এবং দেশের জনসাধারণের বেছে নেওয়া প্রতিনিধি হিসাবে তিনি নাগরিকের অধিকার রক্ষা করতে পারেন মাত্র। সেটা তাঁর বদান্যতা নয়, অবশ্যকর্তব্য। নেতারা মানুষের প্রশ্নের উত্তর না দিলে, প্রশ্ন শুনতে না চাইলে, তাঁদের মনে করিয়ে দিতে হবে যে, ‘মন কি বাত’ একতরফা হয় না। নাগরিকের মনের কথা শোনা প্রজাতন্ত্রে ঐচ্ছিক নয়, আবশ্যিক। রাষ্ট্রের কাছে নাগরিকের প্রাপ্য কম নয়। সেই প্রাপ্যকে ‘রেউড়ি’ বলে অপমান করার অধিকার যেমন কারও নেই, তেমনই তাকেই মোক্ষ বলে ধরে নেওয়াও ভুল। অনুগ্রহকারী-অনুগৃহীতের সম্পর্ক নয়, নাগরিকের সঙ্গে নাগরিকের সমান সম্পর্কই প্রজাতন্ত্রের অভীষ্ট। কেবলমাত্র এই স্বত্বেই দেশের পরিচালকদের সঙ্গে নাগরিকের সম্পর্ক রচিত হতে পারে। ক্ষমতাবানরা সে কথাটি ভুলতে চাইবেন, ভোলাতে চাইবেন— কিন্তু এই মৌলিক সত্যটি বিস্মৃত না হওয়া নাগরিকের কর্তব্য।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Republic Day 2024 India

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy