নিদারুণ নিদাঘবাণে জর্জরিত এ শহরে বারিধারাও প্রশান্তি আনতে পারে না। কারণ, বর্ষা এলেই যে তিলোত্তমার সুখী রূপের খোলসটি খসে গিয়ে উন্মুক্ত হয়ে যায় সারা শরীরের দগদগে পুঁজ-ক্ষত। ভারী বৃষ্টিপাত আর ভাঙা রাস্তা যে কেমন রাজযোটক, হাড়ে হাড়ে জানেন পথযাত্রী ও পরিকাঠামো-রক্ষক উভয়ই। খাস কলকাতার মতো অসমান পথ অন্য রাজ্যের মেট্রো শহরে অকল্পনীয়। খানা-খন্দ আর গর্তই যেন মিছিলনগরীর দিকচিহ্ন, রাজধানীর এই পথদুর্ভোগ ও দায় ঠেলাঠেলি রাজ্যের অন্যত্র বর্ষার মহা-দুর্বিপাকেরই আন্দাজ দেয়। মাত্র গত সপ্তাহের আদ্যভাগেই রাতভর বৃষ্টিতে শহরের বিভিন্ন অংশ জলমগ্ন হয়ে জনজীবনকে শ্লথ করেছিল, আর তার পরের রবিবারের টানা বৃষ্টিপাতে পথের গর্তগুলির দুর্দশা বাড়ল বই কমল না। ফল, স্থানবিশেষে রুদ্ধ জলে ডেঙ্গির ডঙ্কা, যানজট এবং শহরবাসীর নরকদর্শন।
এই বেহাল রাস্তা দীর্ঘ দিনই বহু দুর্ঘটনার উৎস, বর্ষা এলে সেই বিপদও বাড়ে। শহর জলের তলায় গেলে পথের ধসে, খোলা নালায়, বৈদ্যুতিক তারে মৃত্যু পরোয়ানারও সাক্ষী হয়েছেন বাসিন্দারা— বৃষ্টি বাড়লেই তাঁরা প্রমাদ গোনেন। যে শহরে প্রাণের মূল্যই যৎসামান্য, সেখানে সময়ের দাম বা জলে ক্ষতিগ্রস্ত যান-যন্ত্রাংশ মেরামতির ঝক্কি নিয়ে কর্তৃপক্ষের চিন্তার আশা বাতুলতা। রাস্তা বেহাল হওয়ায় পরিবহণও অপ্রতুল— যে গাড়ি পথে নামে, তার ভাড়া স্বেচ্ছানির্ধারিত। বর্ষার শহর, অসাধু ব্যবসায়ীদের মৃগয়াভূমি। দায়িত্ববোধহীনতার নজির হিসাবে দেখানো হয় মেট্রো রেলকে, নির্মাণকাজের সময় তারা নাকি ক্ষতিগ্রস্ত নিকাশির উপযুক্ত প্রতিবিধান করেনি। শহরের কিছু অংশ নিচু, তাই ভারী বৃষ্টি হলেই জল জমবে, এই বিধানও শোনা গিয়েছে। এই অঙ্কে তো সেই অংশগুলি যেমন ঠনঠনিয়া, ক্যামাক স্ট্রিট, বেহালা প্রমুখকে মরসুমি ডোবা রূপে সরকারি স্বীকৃতি দেওয়াই বাঞ্ছনীয়!
নদীনৈকট্য, স্যাঁতসেঁতে আবহাওয়া এবং অসচেতনতায় ভরা এই শহরে পুর-প্রশাসনের সব যুক্তিই হয়তো খণ্ডনীয় নয়। তবে যন্ত্রণা লাঘবেরও কিছু পথ ছিল, সেগুলি পুরসভারই কাজ। যেমন, খাল সংস্কার, পথের নিয়মিত যত্ন। কিন্তু নেতা-কর্তারা সম্বৎসর বিষয়টি ভুলে থাকেন, গাত্রোত্থান ঘটে বর্ষার ঠিক আগে। গত সপ্তাহের অবিরাম বৃষ্টির পর তড়িঘড়ি কিছু রাস্তার সাময়িক মেরামতি শুরু হয়েছে, যার সাফল্য নাকি নির্ভরশীল ছিল শুষ্ক সপ্তাহান্তের উপর! দেশ জুড়ে বর্ষার ঘোর দাপটের মাঝে কয়েক দিন শুষ্ক আবহাওয়ার এই চাহিদা বিচিত্র! প্রশ্ন জাগে, বছরভর উদ্যোগে পলি সরিয়ে নিকাশি, বা প্লাস্টিক ও বর্জ্য নিক্ষেপে নজরদারি চালিয়ে ঝাঁঝরির কিছুটা স্বাস্থ্যোদ্ধার— এ সব যখন হয়েছে, তখন বছরের সাত-আট মাসের শুকনো ঋতুতে পথ সারাই-ই বা হয়নি কেন? তা হলে পুরকেন্দ্র, দলাদলি, কন্ট্রাক্টরদের দুষ্টচক্রের অভিযোগই নিশ্চয় সত্যি, যার কারণে রাস্তা সংস্কারে মঞ্জুর অর্থ বিপথগামী হয় এবং নানা ‘বাধাবিপত্তি’র অবতারণা করে মেরামতি অসম্পূর্ণ থাকে, প্রলম্বিত করা হয়। খরচ বেশি দেখানোর ফন্দি? সংস্কারের পরও বারে বারে রাস্তা বসে পুকুরে পরিণত হলে নিম্নমানের মালমশলা, ভিতের পরতে অবহেলা করে ইটচূর্ণ প্রলেপের প্রবণতা দুর্নীতির সন্দেহকে তীব্রতর করে। বর্ষা আসার আগেই যা করণীয়, বর্ষা এলে তবে সে কাজ শুরুর জন্যই তবে এত অপেক্ষা?
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)