E-Paper

মহাসঙ্কট

প্রয়াগরাজে গঙ্গা ও যমুনার সঙ্গমস্থল থেকে নমুনা পরীক্ষা করে জাতীয় পরিবেশ আদালতের কাছে কেন্দ্রীয় দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ জানিয়েছে, তা মানুষের স্নানের যোগ্য জল নয়।

শেষ আপডেট: ২২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ০৫:০০

পুণ্যার্জনের আশায় কয়েক কোটি মানুষ যে নদীতে স্নান করলেন, তার জল রোগজীবাণুতে দূষিত। প্রয়াগরাজে গঙ্গা ও যমুনার সঙ্গমস্থল থেকে নমুনা পরীক্ষা করে জাতীয় পরিবেশ আদালতের কাছে কেন্দ্রীয় দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ জানিয়েছে, তা মানুষের স্নানের যোগ্য জল নয়। ই-কোলাই, সালমোনেলা-সহ নানা ধরনের আন্ত্রিক রোগ সৃষ্টিকারী ব্যাক্টিরিয়ার উপস্থিতি নিরাপদ মাত্রার চাইতে কয়েকগুণ বেশি। যেমনটা দেখা গিয়েছিল ২০১৯ সালের কুম্ভস্নানের পরেও। এ নিয়ে শোরগোল শুরু হতেই যোগী আদিত্যনাথ সরকারের আধিকারিকরা প্রচার শুরু করেছেন, তাঁরা কত লক্ষ অস্থায়ী শৌচাগার তৈরি করেছেন, কত হাজার টন ব্লিচিং পাউডার, ফিনাইল, ন্যাপথালিন বিতরণ করেছেন, মানববর্জ্য প্রক্রিয়াকরণের কত আধুনিক ব্যবস্থা করেছেন। কিন্তু গলদ গোড়ায়, এবং তা সরকারেরই গলদ— বিপুল পরিমাণ অপরিশোধিত বর্জ্য প্রতি দিন এসে মিশছে গঙ্গা ও যমুনায়। গত নভেম্বর মাসেই জাতীয় পরিবেশ আদালত জানিয়েছিল, উত্তরপ্রদেশ সরকারের পেশ-করা তথ্য অনুসারে সে রাজ্যে উৎপাদিত বর্জ্য এবং পরিশোধিত বর্জ্যের ফারাক রয়ে যাচ্ছে বারো কোটি লিটারেরও বেশি। অর্থাৎ, ওই পরিমাণ অপরিশোধিত মানব-বর্জ্য প্রতি দিন এসে মিশছে গঙ্গায়। নভেম্বরে, প্রয়াগে কোলিফর্ম ব্যাক্টিরিয়ার উপস্থিতি ছিল নিরাপদ মাত্রার চাইতে বেশি। কেন্দ্রীয় দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের হিসাব অনুসারে, প্রায় আড়াইশোটি নালা থেকে নিয়ন্ত্রণহীন ভাবে বর্জ্য এসে মিশছে গঙ্গা ও তার শাখা নদীগুলিতে। মহাকুম্ভের মতো এক বিশাল জনসমাগমের জন্য তা হলে কী প্রস্তুতি নিয়েছিল উত্তরপ্রদেশ সরকার? জাতীয় পরিবেশ আদালতের কাছে অভিযোগ এসেছে, বর্জ্য পরিশোধন এবং জলের মান বিষয়ে কোনও তথ্যই রাজ্য বা কেন্দ্রের কোনও সংস্থা ওয়েবসাইটে নেই। যে জলে তাঁরা স্নান করবেন, তার মান সম্পর্কে জানার অধিকার পুণ্যার্থীদের নেই?

পরের প্রশ্ন হল, দেশের জল, মাটি, হাওয়ার নিরাপত্তা সম্পর্কে অবহিত হওয়ার অধিকার প্রয়োগে কি নাগরিক সত্যিই আগ্রহী? ধর্ম পরমার্থের পথ দেখায়, তা বলে জাগতিক ইষ্ট-অনিষ্টের প্রতি অমনোযোগী হতে বলে না। শ্রীরামকৃষ্ণ এক অনুগামীকে তিরস্কার করে বলেছিলেন, “ভক্ত হবি, তা বলে বোকা হবি কেন?” সাধারণ কাণ্ডজ্ঞান দিয়ে লৌকিক হিত-অহিত বিচারের ক্ষমতা মানুষের সহজাত কবচ-কুণ্ডল। কোনও অলৌকিক লাভের আশায়, অথবা সমবেত উন্মাদনায় সেই ক্ষমতা হারিয়ে ফেলা চরম বোকামি। যা নিজের, এবং বহু মানুষের প্রাণনাশেরও কারণ হতে পারে। দূষিত জলে স্নানের ঝুঁকি বা শ্বাসের মাধ্যমে সংক্রমণ ছড়ানোর বিপদ নিয়ে কতটুকু প্রচার হল? কোভিডের মতো একটা অতিমারি ঘটে গিয়েছে ভারতে, যেখানে জীবাণুর মারণ-ক্ষমতা প্রত্যক্ষ করেছে প্রত্যেকে। অপরের রোগ ও মৃত্যুর জন্য প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে দায়ী হওয়ার ‘পাপ’-ও কি ধুয়ে দিতে পারে তিথি-স্নান?

এ কথা সত্য যে ধর্মস্থানের পবিত্রতার ধারণা, তার মাহাত্ম্যের অনুভব পরিবেশ-বিজ্ঞান বা নগর-ভূগোলের বোধ থেকে আসে না, তার উদ্ভব ধর্মশাস্ত্র, পুরাণ, মহাকাব্য-প্রসূত কল্পনা থেকে। সেই কল্পলোকে গঙ্গা সর্বদাই শিবের জটা থেকে উৎসারিত পাপহারিণী ধারা। প্রতি মিলিলিটার জলে কত ই-কোলাই ব্যাক্টিরিয়া রয়েছে, তার হিসাব কিছুতেই এই মানসলোকের গঙ্গাকে কলুষিত করতে পারে না। এতে ভারী সুবিধে প্রশাসন, রাজনৈতিক দলের। ‘নমামি গঙ্গে’ প্রকল্পের চল্লিশ হাজার কোটি টাকা খরচ হল, গঙ্গার দু’ধারে বর্জ্য প্রক্রিয়াকরণ ব্যবস্থা সম্পূর্ণ হল না কেন, তার উত্তর দিতে হচ্ছে না। তিথিনক্ষত্রের কী বিরল যোগ পড়েছে, তার প্রচারই যথেষ্ট। অতঃপর নানা শহরের হাসপাতালে কুম্ভ-প্রত্যাগত মানুষ আন্ত্রিক, শ্বাসকষ্ট-সহ নানা অসুখ নিয়ে ভিড় করছেন। মহা-আড়ম্বরে মহাকুম্ভের আয়োজন করে, রাজকোষের টাকায় নির্মিত হল জনস্বাস্থ্যের এক মহাসঙ্কট।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Kumbh Pollution

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy