E-Paper

বিষজালিকা

কাজের দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থাকে পাঁচ বছরের জন্য কালো তালিকাভুক্ত করেছে জানালেই পুরসভার দায় শেষ হয় না। পেশাগত সুরক্ষা বিধি ভাঙলে সেই সংস্থা বা ঠিকাদারের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা থাকা উচিত।

শেষ আপডেট: ২৫ নভেম্বর ২০২৫ ০৭:২০

২০২১-এ বিষাক্ত গ্যাসের প্রকোপে কুঁদঘাটের ম্যানহোলে শ্রমিকমৃত্যুর ঘটনায় মৃতদের পরিবারপিছু ৩০ লক্ষ টাকা ও জখমদের পাঁচ লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণের নির্দেশ দিয়েছে কলকাতা হাই কোর্ট। কলকাতা পুরসভাকে দেওয়া ওই নির্দেশ ‘মানববর্জ্য বহনে মানুষের নিয়োগ নিষিদ্ধ এবং নিযুক্তদের পুনর্বাসনের আইন’ (২০১৩) মোতাবেক, যার ভিত্তিতেই জনস্বার্থ মামলা দায়ের হয়। অতিমারির বাজারে শহরে কাজের খোঁজে এসে ম্যানহোলের মৃত্যুফাঁদের বলি হন ওই চার সাফাইকর্মী। মর্মান্তিক, অথচ ব্যতিক্রমী ঘটনা নয়। দেখা গিয়েছে, এমন ক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষ তড়িঘড়ি পরিবারকে কিছু ক্ষতিপূরণ দিয়ে দায় মেটাতে চায়। সম্ভবত, এই ঘটনাও অবহেলার পঙ্‌ক্তিতে থেকে যেত যদি না শ্রমিকদের প্রাপ্যের জন্য লড়ত মানবাধিকার সংগঠন। ২০১৩-য় আইনটি চালুর পরেও দেশ জুড়ে অন্তত ১৫০০ শ্রমজীবী ম্যানহোলে নেমে মারা গিয়েছেন। যেখানে তাঁদের ঠিক সংখ্যাই প্রকাশ্যে আসে না, সেখানে পরিবারের সারল্য ও অসহায়তার সুযোগে ক্ষতিপূরণ পাওয়ার সম্ভাবনা কত ক্ষীণ বোঝা কঠিন কি?

এই আইন অনুযায়ী ম্যানহোলে, সেপটিক ট্যাঙ্কে বর্জ্য বওয়ার কাজে মানুষ নামানো বেআইনি। যদি বিশেষ প্রয়োজনে নামতে হয় তবে সুরক্ষা জ্যাকেট, গ্যাসরোধক মুখোশ, অক্সিজেন সিলিন্ডার, প্রত্যেকের কোমরে দড়ির বাঁধন, প্রা‌ণঘাতী গ্যাস আছে কি না পরীক্ষা ইত্যাদি বাধ্যতামূলক। শীর্ষ আদালতের জারি করা এই সুরক্ষাবিধি মানলে প্রাণহানির আশঙ্কা কমে। নিয়মাবলি মানা দূর, নামানো হয়েছিল মাটি কাটার শ্রমিকদের, যাঁরা প্রশিক্ষিত পর্যন্ত নন। ম্যানহোলের বিপদ সম্পর্কে ধারণাই ছিল না। ফলে, এই মৃত্যুকে নিছক দুর্ঘটনা নয়, অপরাধ বলাই সমীচীন। কর্তৃপক্ষের সদিচ্ছার অভাবে এমন মৃত্যুমিছিল চলছেই। এ বছরের গোড়াতেই চর্মনগরী বানতলায় একই গাফিলতিতে প্রাণ গিয়েছে তিন জনের। অথচ মাত্র তার কয়েক দিন আগেই কলকাতা-সহ ছয় শহরকে এই সংক্রান্ত সুরক্ষাবিধি নিয়ে নির্দেশ দিয়েছিল শীর্ষ আদালত। অর্থাৎ, নিয়মের তোয়াক্কা না করাই নিয়ম হয়ে গিয়েছে।

কাজের দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থাকে পাঁচ বছরের জন্য কালো তালিকাভুক্ত করেছে জানালেই পুরসভার দায় শেষ হয় না। পেশাগত সুরক্ষা বিধি ভাঙলে সেই সংস্থা বা ঠিকাদারের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা থাকা উচিত। এও স্পষ্ট করে বলা আছে, যে পক্ষই প্রত্যক্ষ ভাবে হোক বা পরোক্ষে এমন কাজে শ্রমিক নিয়োগ করবে, তারা এই আইনের আওতায় আসবে। এই অমানবিক কাজ চলছে কি না, সংস্থাগুলি যথাযথ সুরক্ষা ব্যবস্থা রাখছে কি না, এ বিষয়ে প্রশাসন নজরদারি ও তদন্ত কমিটির আশ্বাস দিলেও সংশয় থাকে। কারণ, এ বছরের গোড়াতেই একটি শুনানিতে জানা গিয়েছে দেশের ৭৭৫টির মধ্যে ৪৫৬টি জেলাই এমন শ্রমের অস্তিত্ব জানায়নি। অনুমান করা চলে, ঠিক ভাবে দেখা হয়নি বলেই জানাও যায়নি। অতএব, আইনের জোর ঝাঁকুনি ছাড়া বিষচক্রটি ভাঙবে না। ৩০ লক্ষ টাকা বা আরও বড় অঙ্ক জীবনের মূল্য নয় ঠিকই, তবে, কড়া জরিমানা ও উচিত শাস্তির ভয় সংস্থাগুলিকে নিয়ম মানতে বাধ্য করতে পারে। এই একটি ক্ষেত্রে যন্ত্রকে মানবশ্রমের পরিবর্ত রূপে ব্যবহার করা অত্যন্ত আবশ্যিক। এমন একটি প্রাগৈতিহাসিক ব্যবস্থা যে এখনও চলছে, তার চেয়েও বড় আশ্চর্য হল উপায় থাকলেও সেটি বন্ধের ব্যবস্থা করা হচ্ছে না।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Manhole Death Manhole Calcutta High Court

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy