Advertisement
২৯ নভেম্বর ২০২৩
Ramayana And Mahabharata

বাকি ইতিহাস

রামায়ণ-মহাভারত সেই বিরল গ্রন্থগুলির অন্যতম যেখানে ব্যক্তি ও সমষ্টিজীবনের সকল শিক্ষা নিহিত আছে। সে জন্যই তারা ‘মহাকাব্য’, তাদের গুরুত্বও সুদূরপ্রসারী।

An image of Ramayana and Mahabharata

রামায়ণ-মহাভারত। ছবি: সংগৃহীত।

শেষ আপডেট: ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ০৬:০৮
Share: Save:

সন্তপ্ত দস্যু রত্নাকরের মুখে রামনাম আসছিল না, শব্দটি উল্টে জপ করতে করতে তবে ‘মরা’ হয়েছিল ‘রাম’, এ কাহিনি বহুলপ্রচলিত। উল্টো কথাটি বারংবার বললে প্রকৃত সত্যের স্ফুটন-স্ফুরণ, এ সেই সত্যযুগের সঙ্গেই নির্বাপিত। কলিকালে শাসকের নীতি— বারংবার উল্টো কথাটিই বলা এবং শাসনযন্ত্রের প্রতিটি অঙ্গ-উপাঙ্গ দিয়ে তা বলানো, যাতে লোকে উল্টোটাকেই সত্য বলে বিশ্বাস করে। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় পীঠস্থান হল সংসদ, সেখানেও বা এই অভ্যাস বাদ যাবে কেন! নতুন সংসদ ভবনের সংবিধান গ্যালারিতে দেখা গেল, রামায়ণ-মহাভারতকে তুলে ধরা হয়েছে ‘ইতিহাস’ বলে। ভারত কেন ‘গণতন্ত্রের জননী’ তার ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে এই দুই মহাকাব্যে জনপ্রতিনিধি নির্বাচনে সাধারণ মানুষের অংশী হওয়া, রাম কুরু পুরুর অভিষেকে জনপ্রতিনিধিদের সম্মতির কথা বলা হয়েছে, সে ভাল কথা। তবে কোনটা ইতিহাস, কী তার সংজ্ঞা, রাষ্ট্রের নীতি-নির্ধারকদের সেই নিদান দেওয়ার, এবং সংসদগাত্রে খোদাই করে দেওয়ার স্পর্ধাটি গণতন্ত্রের পক্ষে কাজের কথা নয় মোটেই।

নতুন সংসদ ভবনে ফলকে খোদিত একটিমাত্র শব্দে কী বা আসে যায়— ভাবলে নিতান্ত ভুল হবে, কারণ পুরাণ এবং ‘মহাকাব্য’কে ‘ইতিহাস’-এ পাল্টে দেওয়াটা বিজেপি দল ও সরকারের স্রেফ শব্দ নিয়ে খেলা নয়, ঐতিহ্য নিয়ে আবেগের প্রগল্‌ভ বহিঃপ্রকাশও নয়। এ এক অতি পরিকল্পিত কৌশল। এত কাল মনে করা হচ্ছিল, হিন্দুত্ব ও হিন্দুত্ববাদ নিয়ে যাদের কারবার, তারা রাম-রামায়ণকে রেখে দেবে ধর্ম ও ধর্মীয় রাজনীতির কেন্দ্রেই— যেমন বিজেপি-আরএসএস-ভিএইচপি করে এসেছে অযোধ্যার রামমন্দির নিয়ে সুদীর্ঘ কাল, ইদানীং রামনবমী ঘিরে উগ্রতার বাড়বাড়ন্তেও। উত্তর ভারতের, বিশেষত হিন্দি বলয়ের এক বিরাট অংশে রাম দেবতারূপে পূজ্য; নৈবেদ্যের থালায় ভক্তি উস্কে দিয়ে তাকে ভোটের পাতে টেনে আনার কৌশলে বর্তমান শাসকেরা বহুকালই সিদ্ধহস্ত। ধর্ম নামের প্রতিষ্ঠানটি তাদের কব্জায়, ইদানীং তাঁরা আছেন শিক্ষাক্ষেত্রকে কুক্ষিগত করার তালে। তারই অঙ্গ হল পাঠ্যসূচিতে এমন রদবদল, যাতে নিজেদের ভাবধারা মতাদর্শই বহতা থাকে। তাই এক দিকে পাঠ্যবই থেকেও মোগল ইতিহাস বাদ যায়, আবার সংসদের গ্যালারিতেও ভারতে দীর্ঘ মোগল শাসনের ছিটেফোঁটা মেলে না। বিজ্ঞান বইয়ে ডারউইন সরে যান, ডাক্তারি বিদ্যায় ঢুকে পড়ে চরক-শপথ।

রামায়ণ-মহাভারত সেই বিরল গ্রন্থগুলির অন্যতম যেখানে ব্যক্তি ও সমষ্টিজীবনের সকল শিক্ষা নিহিত আছে। সে জন্যই তারা ‘মহাকাব্য’, তাদের গুরুত্বও সুদূরপ্রসারী। কিন্তু মহাকাব্যকে দেশের ‘ইতিহাস’ বলে দাগিয়ে দিলে অন্য আর এক বিরাট অস্বীকৃতিও মাথা তুলে দাঁড়ায়— উনিশ শতক থেকে শুরু করে বিশ শতকের মধ্যভাগ পর্যন্ত যে দীর্ঘ আন্দোলন ও সংগ্রামের পথ ধরে ভারতীয়রা জাতীয়তার বোধ ও স্বাধীনতা অর্জন করেছেন, সেই অতীত ‘ইতিহাস’কে প্রকৃত মূল্য না দেওয়ার অপরাধ ঘটে। এ নিয়েও বিরোধী দলগুলি কম কথা বলেনি। কিন্তু শাসক দল যে তাতে কর্ণপাতও করেনি তা পরিষ্কার: ভারতের ইতিহাস ‘নিজেদের মতো করে’ লেখার ও লেখানোর প্রক্রিয়াতেই তাদের আগ্রহ। সেই প্রক্রিয়াতে যে পুরাণ রাষ্ট্রনীতির আকর আর মহাকাব্যই ইতিহাস হয়ে উঠবে, বলার অপেক্ষা রাখে না।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
Follow us on: Save:
Advertisement

Share this article

CLOSE