বিজ্ঞান আশীর্বাদ না অভিশাপ, একদা এ ছিল পরীক্ষায় প্রবন্ধ লেখার বিষয়। এ যুগে বিজ্ঞান শব্দটির জায়গা অনায়াসে নিতে পারে সমাজমাধ্যম, অন্তত সেখানে কিছু মানুষের আচরণ দেখে এমন মনে হওয়া অমূলক নয়। নানা ঘটনার সাপেক্ষে দেখানে মন্তব্যের বিস্ফোরণ ঘটে, তাতে মিশে থাকে রাগ ও ক্ষোভ, সঙ্গত কারণেও। কিন্তু কোনও মারাত্মক অপরাধের প্রতিবাদে রাগ দেখাতে গিয়ে সমাজমাধ্যম-ব্যবহারকারীদের একটা অংশ যা করে বসেন সেও অপরাধের শামিল। সাউথ ক্যালকাটা ল কলেজের ঘটনার পরে যেমন মূল অভিযুক্তের সঙ্গে সমাজমাধ্যমে যে মেয়েদের ছবি রয়েছে, তাঁদের লক্ষ্য করে কদর্য মন্তব্য করা হল, তাঁদের ছবি ও ব্যক্তিগত তথ্য ছড়িয়ে দেওয়া হল, হুমকি দেওয়া হল ধর্ষণেরও। আক্রমণের মাত্রা এতটাই, কয়েক জন মেয়ে আতঙ্কে সমাজমাধ্যমের অ্যাকাউন্ট মুছে দিয়েছেন, কেউ পুলিশের সহায়তা চাইছেন। অর্থাৎ, এক ধর্ষণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে গিয়ে কিছু সমাজমাধ্যম-ব্যবহারকারী নিজেরা হাতে তুলে নিতে চাইলেন ‘ধর্ষণ-অস্ত্র’। মূল অভিযুক্ত কলেজের অন্য মেয়েদের যেমন হুমকি দিত ও হেনস্থা করত বলে জানা যাচ্ছে, এঁরাও সেই একই দুষ্কর্ম করে বসলেন।
এই কাজগুলি যাঁরা করছেন, তাঁদের বেশির ভাগই পেশাদার দুষ্কৃতী নন— অনেকেই সমাজের মান্যগণ্য মানুষ। যেমন, সম্প্রতি এক কলেজ শিক্ষকের কথা জানা গেল, যিনি নিজের সমাজমাধ্যম অ্যাকাউন্ট থেকে নিয়মিত প্রবল নারীবিদ্বেষী মন্তব্য করে থাকেন, যেগুলির লক্ষ্য অধিকাংশ সময়েই তাঁর অপছন্দের রাজনৈতিক দলের মহিলা নেতা-কর্মীরা। আরও অনেকেই আছেন, যাঁদের মধ্যে কেউ প্রথম সারির শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্র, কেউ তথ্যপ্রযুক্তি ক্ষেত্রে উচ্চ পদে কর্মরত। অভিজ্ঞতা বলে যে, তাঁরা সবাই বাস্তব জীবনে এমন আচরণ করেন না— কেউ কেউ হয়তো করেন, কিন্তু বেশির ভাগই বাস্তবে অপেক্ষাকৃত সংযত, সুশীল। সমাজমাধ্যমে তাঁদের এই ভয়ঙ্কর রূপটি প্রকট হয়ে ওঠে কেন? তার কারণ বহুবিধ, কিন্তু একটি বিশেষ কারণ হল, সমাজমাধ্যম আক্রমণের লক্ষ্যবস্তুর সঙ্গে এক প্রকার দূরত্ব তৈরি করে— অলীক মানসিক দূরত্ব, আচরণবাদী মনস্তত্ত্বের ভাষায় যাকে ‘ফাজ ফ্যাক্টর’ বলা হয়। মনের গভীরে সঞ্চিত বিষ উগরে দেওয়ার ক্ষেত্রে এই দূরত্ব বিশেষ ভাবে সহায়ক।
অন্য দিকে, অ্যালগরিদম-চালিত সমাজমাধ্যম এক গোত্রের ‘একো চেম্বার’— সেখানে মূলত নিজের কথারই প্রতিধ্বনি শোনেন প্রত্যেকে। ফলে, অল্প সময়ের মধ্যেই মনে হতে থাকে, এই বিষোদ্গারই বুঝি স্বাভাবিক, সকলেই তা-ই করে চলেছে। ফলে, অশালীন আচরণ বা মন্তব্য করার ক্ষেত্রে স্বাভাবিক ভাবে যে সামাজিক কুণ্ঠা থাকে, এই প্রতিধ্বনি-গহ্বর তাকে দূর করে দেয়। বরং, তৈরি করে একটি গড্ডলিকা প্রবাহ। এক জনের দেখাদেখি আরও অনেকে একই কথা বলতে থাকে। ধর্ষণ-হুমকির মতো চূড়ান্ত অন্যায়ের ক্ষেত্রে সে প্রবণতা যদি খানিক কম হয়ও, সংখ্যালঘুর প্রতি বিদ্বেষ বর্ষণ, অথবা কাউকে ট্রোল করার ক্ষেত্রে এই প্রবণতা লাগামছাড়া। এই আচরণ যে-হেতু কার্যত প্রতিটি ক্ষেত্রেই রাজনৈতিক পক্ষপাতদুষ্ট, এবং শাসকের পক্ষে, ফলে তাকে নিয়ন্ত্রণ করার প্রশাসনিক উদ্যোগও কম। আশঙ্কা হয়, এই অনলাইন হিংসা হয়তো আর কিছু দিনের মধ্যেই সম্পূর্ণ ‘স্বাভাবিক’ হয়ে উঠবে। সে দিনটি সত্যই ভয়ঙ্কর হবে।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)