প্রতীকী চিত্র।
ডাক্তারির ছাত্রছাত্রীদের এমবিবিএস পাশের পরে ইন্টার্নশিপের প্রশিক্ষণসূচিতে ‘আয়ুষ’-কেও অন্তর্ভুক্ত করিল কেন্দ্রীয় সরকার। জাতীয় মেডিক্যাল কমিশনের সাম্প্রতিক নির্দেশিকায় বলা হইয়াছে, কমিউনিটি মেডিসিন, সাইকায়াট্রি, সার্জারি, অর্থোপেডিক্স, গাইনোকোলজি, অপথ্যালমোলজি, ইএনটি-র ন্যায় আবশ্যক ক্ষেত্রের পাশাপাশি হবু চিকিৎসকদের এক সপ্তাহের প্রশিক্ষণ লইতে হইবে আয়ুর্বেদ, যোগ, ইউনানি, হোমিয়োপ্যাথির ন্যায় ‘ভারতীয়’ তথা ‘ঐতিহ্যবাহী’ চিকিৎসাবিদ্যার কোনও একটি বিষয়েও। মনে পড়িতে পারে, গত বৎসর নভেম্বরে অন্য এক সরকারি নির্দেশিকায় ঘোষিত হইয়াছিল আয়ুর্বেদের স্নাতকোত্তর স্তরের শিক্ষার্থীদের ৬৬ রকম সার্জিক্যাল প্রশিক্ষণের কথা, যেগুলি সবই ‘অ্যালোপ্যাথি’র অন্তর্গত। আট মাসের মাথায় নয়া ঘোষণায় স্পষ্ট, কেন্দ্রীয় সরকার দেশে কোভিড-আবহে স্বাস্থ্যক্ষেত্রে আধুনিকের সহিত পুরাতনকে মিলাইতে, মিশ্র ঔষধ ও চিকিৎসা-কাঠামো গড়িতে বদ্ধপরিকর।
সরকারের এই ‘মিক্সোপ্যাথি’ চালু করিবার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ কম হয় নাই। ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের বিক্ষোভ, দেশব্যাপী চিকিৎসকদের অনশন, পদযাত্রা, কর্মবিরতিতেও লাভ কিছু হয় নাই। অ্যালোপ্যাথির সহিত আয়ুর্বেদ বা ইউনানি-হোমিয়োপ্যাথিকে মিশাইলে ভারতের ন্যায় দুর্বল স্বাস্থ্য পরিষেবার দেশে চিকিৎসা-ব্যবস্থা সম্পূর্ণ ঘাঁটিয়া যাইবে; সরকারি সমর্থনকে ঢাল করিয়া গ্রামাঞ্চলে ও প্রত্যন্ত এলাকায় হাতুড়েতন্ত্র বাড়িবে— এই সকলই বলা হইয়া গিয়াছে। একুশ শতকে যেখানে অত্যাধুনিক চিকিৎসার হাত ধরিয়া সত্বর কোভিডের টিকা পর্যন্ত বানানো গিয়াছে, সেখানে কেন্দ্রীয় সরকারের পুরাতন চিকিৎসা পদ্ধতিগুলির পৃষ্ঠপোষণ চোখে লাগিতে বাধ্য। প্রাচীনত্ব বা ঐতিহ্য লইয়া কথা চলে না, কিন্তু সেইগুলিকে আধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্থার সহিত ঘটা করিয়া মিশাইয়া দেওয়াতেই আপত্তি। তাহাও ধোপে টিকিতেছে না, কারণ কেন্দ্রীয় সরকারের স্বাস্থ্য নীতিতেই ভারতীয় বিকল্প চিকিৎসা ব্যবস্থার প্রতি জোরদার সমর্থন। ২০৩০-এর মধ্যে ‘এক দেশ, এক স্বাস্থ্য ব্যবস্থা’ গড়ার স্বপ্নে, নীতি আয়োগ গঠিত কমিটিতে, এমনকি ২০২০-র জাতীয় শিক্ষানীতিতেও ‘মেডিক্যাল প্লুরালিজ়ম’-এর ন্যায় শব্দবন্ধের উপস্থিতিই প্রমাণ, কেন্দ্রীয় সরকারের জনস্বাস্থ্য ও চিকিৎসাবিদ্যার রূপরেখায় বিকল্প ধারার চিকিৎসা আপাতত বহাল তবিয়তেই থাকিবে।
প্রাচীন চিকিৎসা ধারার এহেন ‘উত্তরণ’ জাতীয়তাবাদী রাজনীতির পালে হাওয়া জোগাইবে বটে, তবে বিশ্বের কাছে একুশ শতকীয় ভারতীয় চিকিৎসা ব্যবস্থার গ্রহণযোগ্যতা কতখানি বাড়াইবে, তাহা লইয়া সন্দেহ রহিয়া যায়। বিশেষজ্ঞরা বলিতেছেন, অ্যালোপ্যাথির ‘অ্যানেস্থেশিয়া’ আয়ুর্বেদে নাই, সুশ্রুত-তত্ত্বে চোখের ছানি কাটাইবার কথা থাকিলেও ‘লেন্স’ বসাইবার উল্লেখ নাই। যাহা নাই, তাহাকে সম্ভব করিতেই দুই ধারার মিশ্রণের ভাবনা, এহেন যুক্তিও জোরদার নহে, কারণ চিকিৎসাবিদ্যা ওই ভাবে শিখিবার নহে, তাহার সহিত জড়িত দীর্ঘ সময় ও শ্রম, দক্ষ প্রশিক্ষণ ও পরিকাঠামো। অ্যালোপ্যাথিতে নিয়ত পরীক্ষার বিকল্প নাই, প্রাচীন চিকিৎসা অনেকাংশে বিশ্বাসনির্ভর। সরকারি নির্দেশে দুই ধারাকে মিলাইয়া দিলেই তাহা অবিমিশ্র হইবে কী রূপে?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy