দেশের চিকিৎসাব্যবস্থা নিয়ে সমস্যার শেষ নেই। নানা সীমাবদ্ধতার কারণে সরকারি স্বাস্থ্যপ্রতিষ্ঠানগুলি সারা দেশের মানুষের চিকিৎসাসংক্রান্ত বিপুল চাহিদাকে সামাল দিতে পারে না। তার কারণ লোকবল ও আধুনিক সরঞ্জামে ঘাটতি, অনিয়ম-অরাজকতা-অব্যবস্থা, শয্যার অভাব, অপরিচ্ছন্নতা ইত্যাদি বহুবিধ। অনেক সংস্কারের পরেও নাগরিকদের একটি অংশ পরিষেবার মান নিয়ে সন্তুষ্ট নন। এই ফাঁকটি পূরণ করতেই দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে ব্যক্তিগত মালিকানাধীন হাসপাতাল। কিন্তু বিভিন্ন সময়েই এই বেসরকারি স্বাস্থ্যপ্রতিষ্ঠানগুলিকে নিয়ে নানা অসঙ্গতির অভিযোগ উঠেছে। দীর্ঘ ভাবনা, আলোচনার পর বেসরকারি হাসপাতালের চিকিৎসাব্যবস্থার স্বচ্ছতা আনতে ‘ক্লিনিক্যাল এস্টাব্লিশমেন্ট অ্যাক্ট’-এ বদল আনল রাজ্য সরকার। নতুন সংশোধনীতে চিকিৎসা শুরুর সময়েই রোগীকে খরচ সম্পর্কে স্পষ্ট তথ্য দেওয়া ও সেই সীমার মধ্যেই চূড়ান্ত খরচকে বেঁধে রাখার বিষয়টি নিশ্চিত হতে পারে। সন্দেহ নেই, প্রাথমিক ভাবে এই পদক্ষেপ সাধারণ মানুষকে তুষ্ট করবে। কিন্তু এ ভাবে আইন করে চিকিৎসার খরচ নিয়ন্ত্রণ করতে চাইলে আখেরে লাভের চেয়ে ক্ষতির সম্ভাবনাই বেশি।
প্রশ্ন উঠতে পারে, চিকিৎসার খরচ কতখানি ন্যায্য কতখানি নয়, তার সরকারি বিচার কী ভাবে হবে। একটি রোগের চিকিৎসা শুরু হওয়ার পর আরও সমস্যা দেখা দিতে পারে, রোগ অন্য দিকে বাঁক নিতে পারে। তাই খরচের এই ঊর্ধ্বসীমা বেঁধে দিলে রোগীর সুচিকিৎসার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা দেখা দিতে পারে। কোভিডের পরই একটি সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, আইসিইউ বা আইটিইউ-তে রেখে সঙ্কটাপন্ন রোগীর চিকিৎসার ৯০ শতাংশই হচ্ছে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলিতে। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের অসাধু উদ্দেশ্যও যেমন থাকে, তেমনই উন্নত ও আধুনিক মানের চিকিৎসার সরঞ্জাম, ওষুধ ও সর্বক্ষণ নজরদারির প্রয়োজনেও খরচ বাড়তে পারে। অতএব, চিকিৎসায় খরচ কত হতে পারে, সরাসরি তাতে সরকারি নাসিকা-ক্ষেপণ অনুচিত। তবে, হাসপাতাল-বিলের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা এবং রোগীর অনুমতিসাপেক্ষে চিকিৎসা এগোনোর প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। কোন হাসপাতালে কেমন খরচ, তা নিয়ে মানুষকে ওয়াকিবহাল রাখলে, তিনি তাঁর সাধ্যানুযায়ী হাসপাতালে যাবেন। তাও সম্ভব না হলে, সরকারি হাসপাতালের দ্বারস্থ হবেন। ‘বেছে নেওয়া’র এই সুযোগ কিন্তু জনসাধারণের প্রাপ্য।
বেসরকারি হাসপাতালে দুর্নীতি রুখতে স্বাস্থ্য ভবনের তরফ থেকে বিধিনিয়ম রাখাই যথেষ্ট। তাদের বিরুদ্ধে নিয়মভঙ্গ, ইচ্ছাকৃত বিল বাড়ানোর অভিযোগ পেলে তা খতিয়ে দেখার জন্য রাজ্য সরকারের তরফে একটি কমিশন ইতিমধ্যেই সক্রিয়। সেখানে বহু মানুষ ক্ষতিপূরণও পেয়েছেন। এর পরও বিষয়টাকে আইন এনে নিয়ন্ত্রণ করার প্রয়োজন নেই। বছর কয়েক আগে একটি মামলায় আদালত থেকেও রায় দেওয়া হয়েছিল, বেসরকারি স্বাস্থ্যপ্রতিষ্ঠানের খরচ স্থির করে দেওয়ার অধিকার সরকারের নেই। ভারতে এমনিতেই আইনের আতিশয্য, সব কিছুকেই আইনের আওতায় এনে ভোটব্যাঙ্ককে পুষ্ট করার প্রবণতা বহমান। আইনের ভয় দেখিয়ে অপরাধমনস্কদের রোখা যায় না। বরং এতে জটিলতা ও সময়ের অপচয় বাড়ে। তাই অন্য বিকল্পও ভাবতে হবে।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)