E-Paper

অসুরক্ষিত আশ্রয়

নিজ গৃহ, পরিবার— মেয়েদের নিরাপদতম আশ্রয়স্থল হিসাবে গণ্য পরিসরগুলিতেও তাদের জীবন তছনছ হওয়া সম্ভব। তার জন্য বন্দুকও লাগে না— পুরুষতন্ত্রের নিষ্পেষণ অমোঘ।

শেষ আপডেট: ২১ জুলাই ২০২৫ ০৫:০৮

আর একটা সুযোগ দাও আমায়। পরের বার আরও ভাল করে পড়ব।” ষোলো বছরের সাধনা ভোসলে-র শেষ অনুরোধ ছিল বাবার কাছে। বাবা শোনেননি। বরং ডাক্তারির সর্বভারতীয় প্রবেশিকা পরীক্ষা ‘নিট’-এর প্রস্তুতি পরীক্ষাগুলিতে ভাল ফল করতে না পারার ‘অপরাধ’-এ পাথর পেষাই করার যন্ত্রের ভারী হাতল দিয়ে নির্দয় প্রহার করেছিলেন মেয়েকে। অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে মৃত্যু হয় মহারাষ্ট্রের কিশোরীর। এই ঘটনার মাসখানেকের মধ্যেই হরিয়ানার টেনিস খেলোয়াড় রাধিকা যাদবের বাবা মেয়েকে গুলি করে মারার পর দাবি করেন, মেয়ের উপার্জনে খাচ্ছেন— এমন বিদ্রুপ প্রতিনিয়ত শুনে তাঁর আত্মসম্মানে আঘাত লাগে, এবং তিনি এই ভয়ঙ্কর কাণ্ড ঘটান। রাধিকার জীবনযাপন, ভাবনাকে তিনি মেনে নিতে পারেননি— এমন তত্ত্বও উঠে এসেছে। হত্যার প্রকৃত কারণ খোঁজার দায়িত্ব পুলিশ-প্রশাসনের। কিন্তু সামান্য সময়ের ব্যবধানে স্বগৃহে বাবার হাতে দুই কন্যার এমন পরিণতি একটি মর্মান্তিক সত্যকে প্রকট করে তোলে। নিজ গৃহ, পরিবার— মেয়েদের নিরাপদতম আশ্রয়স্থল হিসাবে গণ্য পরিসরগুলিতেও তাদের জীবন তছনছ হওয়া সম্ভব। তার জন্য বন্দুকও লাগে না— পুরুষতন্ত্রের নিষ্পেষণ অমোঘ।

ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরো-র পরিসংখ্যান জানাচ্ছে, মেয়েদের উপর ঘটা অপরাধের এক-তৃতীয়াংশই ঘটে তার নিজের বাড়িতে। কিন্তু প্রাপ্ত পরিসংখ্যান পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যাবে, তা থেকে স্বামী বা শ্বশুরবাড়ির লোকের হাতে বিবাহিত মেয়েদের উপর ঘটা নির্যাতনের ছবিটি স্পষ্ট হলেও, জন্মপরিবারে মেয়েদের সঙ্গে যে অপরাধগুলি ঘটে চলে, তা প্রায় অদৃশ্য। সম্প্রতি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা স্বয়ম-এর একটি সমীক্ষা সেই চির-উপেক্ষিত দিকটির প্রতি আলোকপাত করেছে। বিভিন্ন ধরনের প্রেক্ষাপট থেকে উঠে আসা মেয়েদের সঙ্গে কথা বলার পর সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, জন্মপরিবারে মা-বাবা বা ভাইবোনের হাতে মেয়েদের হিংসার শিকার হওয়ার ঘটনাটি পরিবারের কাছে ‘স্বাভাবিক’ হিসাবেই প্রতিপন্ন হয়। তার মধ্যে যেমন শারীরিক অত্যাচার রয়েছে, তেমনই আছে মৌখিক, মানসিক, আর্থিক এবং যৌন নির্যাতনও। নির্যাতনের এই ধারা চলে আসছে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে, পারিবারিক অনুশাসনের নামে, শৃঙ্খলা শেখানোর নামে। পরিস্থিতি এমনই যে, নির্যাতিতা নিজেও ক্ষেত্রবিশেষে স্বাভাবিক-অস্বাভাবিকের পার্থক্যটি বিস্মৃত হয়।

সমস্যা হল, পুরুষতান্ত্রিকতার এই রূপটি সমাজের এত গভীরে প্রবেশ করেছে যে, আইন তার নাগাল পায় না। এবং তা এতই সূক্ষ্ম যে, প্রতিনিয়ত তার উপস্থিতি থাকলেও, আলাদা ভাবে তার অস্তিত্বটি অনুভব করা যায় না। যে মানসিকতা কন্যাসন্তানের তুলনায় পুত্রসন্তানটির পুষ্টি, লেখাপড়ার প্রতি অধিক গুরুত্ব দেয়, সেই একই মানসিকতা নাবালিকা মেয়েকে পাত্রস্থ করতে চায়, পছন্দের চাকরিতে বাধা দেয়, পছন্দের জীবনসঙ্গী বাছায় পারিবারিক সম্মানহানির ওজর তোলে। কখনও আবার সুরক্ষার নামে তার জীবন যাপনে কঠোর প্রহরা বসায়। সমাজ, এমনকি রাষ্ট্রও— ‘রক্তের সম্পর্ক’, ‘পারিবারিক বন্ধন’-এর আড়ালে এই অন্ধকার লুকিয়ে রাখতে চায়। রাধিকা, সাধনাদের স্বপ্নগুলির অকালমৃত্যুই তাই নিয়তি হয়ে ওঠে, আজও।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

National Crime Records Bureau Patriarchal Society

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy